Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

‘ভুতুড়ে’ ঘর বালি ব্রিজে, ভয়ে কাঁটা পুরো এলাকা

সূর্য ডুবলেই নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারপাশে গজিয়ে ওঠা বট-অশ্বত্থ গাছ, মাকড়সার জালে মোড়া জানালাহীন বদ্ধ ঘরগুলির কোনওটায় তখন জমে ওঠে নেশার আসর। কোনওটায় আবার টিমটিমে কুপির আলোয়, গাঁজার ধোঁয়ায় ঢেকে সাধনায় বসেন ভিনদেশি সাধু। অসামাজিক কাজকর্মও যে হয় না, তা-ও হলফ করে কেউ বলতে পারেন না।

সেতুর দুই প্রান্তে সেই ঘর। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

সেতুর দুই প্রান্তে সেই ঘর। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৫২
Share: Save:

সূর্য ডুবলেই নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারপাশে গজিয়ে ওঠা বট-অশ্বত্থ গাছ, মাকড়সার জালে মোড়া জানালাহীন বদ্ধ ঘরগুলির কোনওটায় তখন জমে ওঠে নেশার আসর। কোনওটায় আবার টিমটিমে কুপির আলোয়, গাঁজার ধোঁয়ায় ঢেকে সাধনায় বসেন ভিনদেশি সাধু। অসামাজিক কাজকর্মও যে হয় না, তা-ও হলফ করে কেউ বলতে পারেন না।

গ্রামগঞ্জের হানাবাড়ি নয়। পরিত্যক্ত এই চারটি ‘ভুতুড়ে ঘর’ একেবারে গঙ্গার উপরে, বালি ব্রিজের দুই প্রান্তে। পুলিশও মাঝেমধ্যে হানা দিয়ে এ সব ঘর থেকে পাকড়াও করে চোর-ছিনতাইবাজদের। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তো বটেই, এমনকী পুলিশের কাছেও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘরগুলি।

সেতুর প্রায় লাগোয়া দক্ষিণেশ্বর মন্দির। মাঝেমধ্যেই আসে নাশকতার হুমকিও। যদিও নিরাপত্তাহীন হয়েই পড়ে থাকে বালি ব্রিজ। তার উপরেই এমন চারটি ঘর আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে উদ্বেগ। এক প্রাক্তন পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘পরিত্যক্ত ওই চারটে ঘর ব্রিজের চার কোণে। সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে সেতুতে এবং অন্যত্র নাশকতামূলক কাজের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’’ আবার গোটা বালি ব্রিজের কোথাও সিসি ক্যামেরার নজরদারি পর্যন্ত নেই। ফলে ব্রিজের কোথায় কী ঘটছে, তা জানা সম্ভব নয় পুলিশের পক্ষেও।

দিন কয়েক আগেই বালি ব্রিজের দক্ষিণেশ্বরমুখী রাস্তা মেরামত করা হয়েছে। সেই সময়ে দক্ষিণেশ্বরের দিককার দু’টি ঘরের একটিতে ইমারতি দ্রব্য মজুত করেছিল পূর্ত দফতর। অন্যটিতে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশকর্মীদের অস্থায়ী ক্যাম্প হয়েছিল। কিন্তু সেতুর কাজ শেষ হওয়ার পরে চারটি ঘর ফের পুরনো অবস্থাতেই ফিরে এসেছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

১৯৩২ সালে কলকাতার সঙ্গে হাওড়া-হুগলিকে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত করতে ৮৮০ মিটার লম্বা স্টিলের সেতুটি তৈরি করেছিলেন পেশায় রেলের ঠিকাদার রায়বাহাদুর জগমল রাজা চৌহান। সেতু তৈরির পরে বালি ও দক্ষিণেশ্বরের দিকে দু’টি করে মোট চারটি ঘর তৈরি হয় টোল-ট্যাক্স নেওয়ার জন্য। পথচারী ও যানবাহন, সকলকেই এক দিক থেকে টিকিট কেটে ব্রিজে উঠে অন্য দিকে নামার সময়ে তা জমা দিতে হতো। বালির পুরনো বাসিন্দা পেশায় আইনজীবী অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘হেঁটে ব্রিজ পার হতে গেলে দু’আনা এবং গাড়ি গেলে আট আনা দিয়ে টিকিট কাটতে হতো। তবে সত্তরের দশক থেকে ওই টোল ট্যাক্স নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তার পর থেকেই ঘরগুলি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।’’

প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই নীচে গঙ্গার পাড়ে নামার সিঁড়ি। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলিও এখন ব্যবহারযোগ্য নেই। বেশ কয়েক বছর আগে সেতুর দক্ষিণেশ্বরমুখী রাস্তার বালির দিকের একটি ঘর থেকে লরি ছিনতাইয়ের একটি দলকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। জানা যায়, সকাল থেকে নিজেদের শ্রমিক পরিচয় দিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার অছিলায় ওই ঘরে ঢোকে কয়েক জন যুবক। পুলিশ তল্লাশি করতে এসে দেখে, ওই যুবকদের প্রত্যেকের কোমরে বাঁধা রয়েছে শাড়ির সরু পাড়। যা দিয়ে ওই লরিচালকের গলায় ফাঁস দেওয়া হয়েছিল।

স্থানীয়দের দাবি, ব্রিজ মেরামতির পাশাপাশি ঘরগুলি নিয়েও ভাবনাচিন্তা করুক প্রশাসন। বাসিন্দাদের পাশাপাশি গাড়ির চালকদের কথায়, ‘‘প্রয়োজনে দু’পাশে পুলিশের দু’টি আউটপোস্ট তৈরি করলেও সেতুর নিরাপত্তা বজায় থাকবে। বাকি দু’টি ঘরে রেস্তোরাঁ বা অন্য কিছু বানানো যেতে পারে। তাতে বিনোদনের ব্যবস্থাও হবে।’’

যদিও এ বিষয়ে সেতু মেরামতির দায়িত্বে থাকা পূর্ত দফতরের তরফে এখনও তাঁদের কাছে কোনও প্রস্তাব আসেনি বলেই দাবি হাওড়া ও কামারহাটি পুরসভার। প্রস্তাব এলে বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই ভাবনাচিন্তা করা হবে বলেও জানান পুর-কর্তৃপক্ষ। হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ (সৌন্দর্যায়ন) বিভাস হাজরা বলেন, ‘‘দক্ষিণেশ্বর আন্তর্জাতিক মানের তীর্থস্থান। তার পাশেই বালি ব্রিজ। তাই সেখানে সৌন্দর্যায়ন বা বিনোদনের ব্যবস্থার প্রস্তাব পেলে মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেব।’’ এ বিষয়ে পূর্ত দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘ব্রিজ মেরামতির সময়েই বিষয়টি নজরে এসেছিল। এর পরেই ওই চারটি ঘরের আদল এক রেখে মেরামতি ও রং করার পরিকল্পনা হয়েছে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Bally bridge panic haunted
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE