Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

অনটন জয় করে লড়াইয়েই স্বপ্নের উড়ান

বেনিয়াপুকুরের ৪২ নম্বর মফিদুল ইসলাম লেন। বস্তির ঘুপচি ঘরের কন্যা আয়েশা নূর এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ক্যারাটের একাধিক পদক জিতে সকলের মন জয় করেছেন।

দৃঢ়সঙ্কল্প: সবাইকে নিয়ে এ ভাবেই চলছে আয়েশার প্রশিক্ষণ। মৌলালির রামলীলা ময়দানে। নিজস্ব চিত্র

দৃঢ়সঙ্কল্প: সবাইকে নিয়ে এ ভাবেই চলছে আয়েশার প্রশিক্ষণ। মৌলালির রামলীলা ময়দানে। নিজস্ব চিত্র

মেহবুব কাদের চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৭ ০১:৫৯
Share: Save:

ছোট থেকে অসুস্থতা বা দারিদ্র তাঁকে দমাতে পারেনি। বস্তির এক চিলতে বাড়ি থেকে উঠে আসা মেয়েটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, হার না মানা জেদ আর পরিশ্রম থাকলে জয় আসতে বাধ্য।

বেনিয়াপুকুরের ৪২ নম্বর মফিদুল ইসলাম লেন। বস্তির ঘুপচি ঘরের কন্যা আয়েশা নূর এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ক্যারাটের একাধিক পদক জিতে সকলের মন জয় করেছেন। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রবল অভাবের সংসার মা শাকিলা খাতুনের। ট্যাক্সিচালক বাবা পাঁচ বছর আগে মারা গিয়েছেন। দিদি তবাস্সুম সদ্য কলেজের গণ্ডি পার করেছেন এবং ভাই ফারুক সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশোনা করছেন। বড়দাদা তনবীরের ছোট্ট একটা ব্যবসা রয়েছে। সংসারে আর রোজগেরে বলতে রয়েছেন মা। তিনি কাপড় সেলাই করে কোনও রকমে সংসার চালান।

জীবনের প্রতিটি পরতে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মোটে দমে যাওয়ার পাত্রী নন আয়েশা। তিন বছর বয়স থেকে মৃগী রোগে আক্রান্ত তিনি। ছোটবেলায় দাদা তনবীর ক্যারাটে শিখতেন। আর তাঁর দাদাকে দেখেই পাঁচ বছর বয়স থেকে ক্যারাটে শেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন আয়েশা। বা়ড়ির পাশেই রয়েছে লেডিস পার্ক। সেখানে ক্যারাটে শেখান এম এ আলি। তাঁর প্রশিক্ষণেই তৈরি হয়েছেন আয়েশা।

আয়েশার কথায়, ‘‘কঠোর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আলি স্যার যে ভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাতে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। তিনি না থাকলে আমার এত দূর উঠে আসা হতোই না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘২০১২ সালে দিল্লিতে নির্ভয়া-কাণ্ডের পরে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলাম ক্যারাটে শিখতে। বুঝে গিয়েছিলাম, মেয়েদের আত্মরক্ষার স্বার্থে মেয়েদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য আমি ওই বছর থেকেই মৌলালির রামলীলা ময়দানে মেয়েদের নিয়মিত ক্যারাটের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি।’’ বর্তমানে সপ্তাহে দু’দিন (বৃহস্পতিবার ও রবিবার) সকালে প্রায় ৯০০ জন কিশোরীকে বিনা পয়সায় ক্যারাটের পাঠ দেন আয়েশা।

ইতিমধ্যেই তাঁর জীবনসংগ্রামে মুগ্ধ হয়েছে একাধিক দেশ। দেশ-বিদেশ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছেন আয়েশা। তাঁর জীবন নিয়ে আমেরিকার
একটি টেলিভিশনের তরফে তথ্যচিত্রও তৈরি করা হয়েছে। বছর খানেক আগে দিল্লিতে আমেরিকান সেন্টারে মার্কিন সরকার তাঁকে ‘দ্য হিরো অব জেন্ডার ইকুয়ালিটি’ সার্টিফিকেট দিয়ে সম্মানিত করেছে। মুম্বই, সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক, আবু ধাবি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশ-বিদেশ থেকে ক্যারাটের একাধিক পদক জিতে নিয়ে এসেছেন তিনি। আয়েশার সাহসিকতার লড়াইয়ে অভিভূত হয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মানেকা গাঁধীও সম্প্রতি টুইট করেছেন।

তবে আয়েশার স্বপ্ন থাকলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। শারীরিক কারণে চতুর্থ শ্রেণির পরে আর পড়া হয়ে ওঠেনি। আয়েশার প্রশিক্ষক এম এ আলির কথায়, ‘‘এ বছর অক্টোবরে ক্যারাটে প্রতিযোগিতায় ইংল্যান্ড যাওয়ার কথা ছিল আয়েশার। কিন্তু সেই সময়ে বারবার অসুস্থ হওয়ার জন্য আর যেতে পারেনি।’’

মা শাকিলা খাতুন বলেন, ‘‘ছোট বেলাতেই আয়েশার মৃগী রোগ ধরা পড়ে। কিন্তু টাকাপয়সার টানাটানির কারণে সঠিক চিকিৎসা করা হয়নি মেয়েটার। বাগুইআটির একটি স্কুলের শিক্ষক প্রতি মাসে ওঁর ওষুধ বাড়িতে এসে পৌঁছে দিয়ে যান।
এমনই কিছু উদার মানুষের জন্য লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারছে। অবশ্য নিয়মিত ওষুধ খেলেও ওর অজ্ঞান হওয়াটা কোনও ভাবেই আটকানো যাচ্ছে না।’’ রাজ্য সরকারের কাছে আয়েশার মায়ের আবেদন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমার অনুরোধ, আমার মেয়েটার জন্য তিনি যদি একটা সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন, তা হলে আমাদের পরিবার ওঁর প্রতি খুব কৃতজ্ঞ থাকবে।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy