শোক: কাশ্মীরে নিহত জওয়ানদের স্মরণে মিছিল। পার্ক স্ট্রিট চত্বরে। ছবি: সুমন বল্লভ
রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যু সমবেত শোক প্রকাশের ধারায় পরিবর্তন এনেছিল এই শহরে। আগে যা বিচ্ছিন্ন ভাবে হত, সেই মোমবাতি-মিছিল একটা সংগঠিত রূপ পেয়েছিল ওই ঘটনার পর থেকেই। জানাচ্ছেন মোমবাতি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত লোকজন। যত দিন গিয়েছে, ছোট-বড় যে কোনও বিপর্যয়ে মোমবাতি-মিছিলই হয়ে উঠেছে শহরের প্রতিবাদের স্বর, শোকের প্রতীক। সাম্প্রতিক সময়ে সমবেত সেই শোক-প্রকাশের ভাষাই ‘নজিরবিহীন’ ব্যবসা করল! বিক্রি বাড়ল ১০০ শতাংশ। আর ক্রেতাদের চাহিদা মেনে বদল এল মোমবাতি তৈরির প্রক্রিয়াতেও। মোমবাতি হাতে হাঁটতে হয় অনেকটা পথ। মোম যাতে গলে হাতের উপরে না পড়ে, সেই কারণে ভাবনায় বৈচিত্র এনে ইদানিং তৈরি হচ্ছে নতুন ধরনের মোমবাতি।
রাজ্যের মোমবাতি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ওয়াক্স বেসড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’-এর সেক্রেটারি সমীর দে জানালেন, কোনও ছবি বা মূর্তির সামনে যে ধরনের মোমবাতি জ্বালানো হয় এবং যে মোমবাতি হাতে নিয়ে শোক মিছিলে হাঁটা হয়, এই দুইয়ের গড়ন এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আলাদা। মিছিলের জন্য যে মোমবাতি তৈরি হয়, সেগুলি যাতে হাতে না পড়ে, সে দিকে নজর দেওয়া হয়। সমীরবাবুর কথায়, ‘‘এই মোমবাতির মুখ খানিকটা চওড়া হয়। তাই মোম সলতের কাছেই পড়তে থাকে। সামান্য হেলিয়ে ধরলে ফোঁটাগুলি রাস্তায় পড়বে। কোনওভাবেই হাতে পড়বে না।’’
পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা ও তার পর থেকে নানা জায়গায় মোমবাতি মিছিলের জন্য গত সাত দিনে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মোমবাতি পুড়েছে। মোমবাতি বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে ২২ লক্ষ টাকার। শুধুমাত্র এই কলকাতাতেই! খোদ মুখ্যমন্ত্রীও মোমবাতি মিছিল করেছেন। গত কয়েক দিনে শতাংশের হিসেবে মোমবাতি ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০০ শতাংশ। এখন ‘অফ সিজন’ হওয়া সত্ত্বেও! পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ‘অফ সিজন’-এর কারণে ছুটিতে থাকা কর্মীদের ফোন করে ডেকে ফের কাজে নিয়োগ করা হয়েছে, মিছিলে মোমবাতি সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য।
আরও পড়ুন: ‘মাস্টারমশাই’কে দেখতে ভিড় কোর্টে
কিন্তু ব্যবসা বাড়াটা খুশির কারণ হলেও যে কারণে তা বেড়েছে, তার পুনরাবৃত্তি ফের হোক, কখনওই চান না মোমবাতি ব্যবসায় যুক্ত লোকজন। সমীরবাবু বলেন, ‘‘এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এই কারণে ব্যবসা বৃদ্ধি খুশির কারণ হতে পারে না। কিন্তু পরিস্থিতিই এমন যে, চাহিদা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’’
শোক-প্রকাশে মোমবাতি-মিছিলের ধারা কবে থেকে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইতিহাসবিদ সুরঞ্জন দাস জানাচ্ছেন, মোমবাতি জ্বালিয়ে শোক-প্রকাশ (টু মোর্ন আ ডেথ) মূলত ইউরোপীয় ধারা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ বা ঊনবিংশ শতকের প্রথম থেকে এই ধারা আস্তে-আস্তে একটা সামগ্রিক রূপ পেতে থাকে। মূলত জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স-সহ একাধিক দেশে শোক-প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মোমবাতি জ্বালানো হত। সুরঞ্জনবাবুর কথায়, ‘‘বর্তমানে সারা বিশ্বে শুধু শোক-প্রকাশই নয়, প্রতিবাদের প্রতীকি ভাষা হিসেবেও মোমবাতি জ্বালানো হয়।’’
এমনিতে মোমবাতির মরসুম শুরু হয় আষাঢ় মাসে। শিবরাত্রি থেকে মোমবাতি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়, তা তুঙ্গে ওঠে পুজোর মরসুমে, বিশেষত দীপাবলির সময়ে। পুজোর পরে বড়দিন ও নতুন বছরের জন্য কিছু মোমবাতি বিক্রি হয়। তার পর থেকেই ব্যবসায় ভাটা আসে। তাই এই সময়ে মোমবাতি ব্যবসায় যুক্ত কর্মীরা বাড়ি চলে যান। তাঁরা প্রায় সকলেই অন্য সময়ে চাষবাস করেন। কিন্তু পুলওয়ামা জঙ্গি হামলা সেই নিয়মেই বড় ধাক্কা দিয়েছে।
সংগঠন সূত্রের খবর, গত সাত দিনে রাজ্যে প্রায় ১২ লক্ষ মোমবাতি উৎপাদন হয়েছে। তা ঝড়ের গতিতে বিক্রিও হয়ে গিয়েছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা! ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, এই সময়ে শহরে সব মিলিয়ে দু’-আড়াই লক্ষ মোমবাতি বিক্রি হয়। কিন্তু জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে সেই বিক্রিই দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। এ শহরে প্রায় দেড়শোটি মোমবাতি প্রস্তুতকারক সংস্থা রয়েছে বলে জানাচ্ছে মোমবাতি ব্যবসায়ীদের ওই সংগঠন। পুলওয়ামা জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে চাহিদা সামলাতে খিদিরপুর, বেহালা, কসবা-সহ সব ইউনিট থেকেই মোমবাতি সরবরাহ করা হয়েছে। বড়বাজারের এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘আমাদের কাছে এটা একটা জরুরি পরিস্থিতি। যা মজুত ছিল, তা থেকেই সব নিতে হচ্ছে।’’ খিদিরপুরের অন্য ব্যবসায়ী আবার বলছেন, ‘‘যা ঘটেছে, তাতে মোমবাতি তো সরবরাহ করতেই হবে। ওই জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের যতটুকু ভূমিকা থাকে আর কি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy