পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণের ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ‘সাজানো ঘটনা’। বৃহস্পতিবার সেই সাজানো ঘটনার তত্ত্ব খারিজ করে দিল আদালত। ওই গণধর্ষণের ঘটনার তিন অভিযুক্ত নাসের খান, রুমান খান এবং সুমিত বজাজকে এ দিন দোষী সাব্যস্ত করল নগরদায়রা আদালত। আগামিকাল শুক্রবার তাদের সাজা ঘোষণা করা হবে। এই ঘটনার মূল অভিযুক্ত কাদের খান এবং আর এক অভিযুক্ত মহম্মদ আলি খানকে অবশ্য এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ।
চার বছর আগে এই অভিযোগ করে প্রথমে পুলিশকর্মী এবং পরে শাসক দলের একাধিক নেতা-নেত্রীর বিদ্রুপ ও অসম্মানজনক মন্তব্যের মুখে পড়া ধর্ষিতা সুজেট জর্ডন অবশ্য এই রায় শুনে যেতে পারলেন না। এ বছরের ১৩ মার্চ এনসেফালাইটিসে মারা যান তিনি।
রায় ঘোষণার পরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর আগের ‘সাজানো ঘটনা’-র প্রসঙ্গ তোলেননি। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আদালতের রায়কে আমি স্বাগত জানাচ্ছি।’’ ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন, দোষীদের কড়া শাস্তি হওয়া উচিত। তিনি চান, দোষীরা সারা জীবন জেলে থাকুক। নির্যাতিতা সুজেট জর্ডনের বাবা পিটার জর্ডন এ দিন আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘ঘটনাটি যে সাজানো ছিল না, তা প্রমাণিত হল।’’
আরও পড়ুন: সাফল্য তাঁর একার নয়, ঘোষণা দময়ন্তীর
চিরচেনা পার্ক স্ট্রিট এমন আঁধার নামাবে, ভাবেননি সুজেট
রুমান, নাসির (পিছনে) এবং সুমিত (মুখ ঢাকা)।
পুলিশ সূত্রের খবর, ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পার্ক স্ট্রিটের একটি হোটেলের সামনে থেকে সুজেটকে গাড়িতে তোলে পাঁচ যুবক। চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ করে তাঁকে এক্সাইড মোড়ের কাছে ফেলে দেয় তারা। ৮ ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিট থানায় অভিযোগ জানালেও পুলিশ প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ করেছিলেন সুজেট। পরে বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতেই নড়েচড়ে বসে লালবাজারের একাংশ। থানা থেকে ওই ঘটনার তদন্তভার তুলে দেওয়া হয় গোয়েন্দা বিভাগের হাতে। অভিযোগকারীর বয়ান অনুযায়ী, প্রথমে দুই যুবককে আটক করে পুলিশ। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে ঘটনার কোন যোগ না থাকায় ফের ডেকে পাঠানো হয় অভিযোগকারিনীকে। পরে ওই হোটেলের সিসিটিভির ছবি দেখে চিহ্নিত করা হয় পাঁচ জনকে। এর পরেই গ্রেফতার করা হয় নাসের খান, রুমান খান এবং সুমিত বাজাজকে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সুমিত ঘটনার দিন গাড়ি চালাচ্ছিল।
ঘটনার চার বছর পরে কেন মূল অভিযুক্ত কাদেরকে গ্রেফতার করা গেল না তা নিয়ে এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। পুলিশের একাংশই প্রশ্ন তুলেছে, রানাঘাটের সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণের ঘটনায় রাজ্যের গোয়েন্দারা তিন বাংলাদেশি-সহ সব অভিযুক্তকে তিন মাসের মধ্যেই গ্রেফতার করেছিল। অথচ সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশই চার বছর ধরে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের মূল অভিযুক্তের হদিশ পেল না। পুলিশের একাংশের অভিযোগ, কাদেরের সঙ্গে শাসক দল এবং পুলিশের একাংশের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, কাদেরের বান্ধবী টলিউডের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে রাজ্যের এক মন্ত্রীর সম্পর্ক খুবই ভাল। সেই সূত্র ধরেই ওই প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠেছিল কাদেরের। পুলিশের ওই অংশের অভিযোগ, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের তদন্তকারীরা যখনই কাদেরের খোঁজ করেছেন, তখনই ওই মন্ত্রী এবং পুলিশের একটি অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। মুম্বইয়ের একটি হোটেলে পুলিশ এক বার কাদেরের নাগালও পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গোয়েন্দারা ওই হোটেলে পৌঁছনোর মিনিট দশেক আগে হোটেল থেকে বেরিয়ে যায় কাদের। ওই সময়ে পুলিশের একাংশের অভিযোগ ছিল, পুলিশের ভিতর থেকেই এই অভিযানের তথ্য কাদেরের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। তা না হলে কাদেরের পক্ষে অত দ্রুত পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না বলেই পুলিশের ওই অংশের অভিযোগ।
বস্তুত এই গণধর্ষণের ঘটনার পর থেকেই শাসক দলের কোপের মুখে পড়েছিলেন সুজেট। মুখ্যমন্ত্রী এটিকে শুধু ‘সাজানো ঘটনা’ বলেই ক্ষান্ত হননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই ঘটনাটি সাজানো হয়েছে।’’ মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিৎ পচনন্দা সাংবাদিক সম্মেলন করে একই সুরে বলেন, ‘‘সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে এই অপপ্রচার করা হচ্ছে।’’ তৃণমূলের সাংসদ অর্পিতা ঘোষ, কাকলি ঘোষদস্তিদার-সহ একাধিক নেতা সুজেটের চরিত্র নিয়েই প্রকাশ্যে কটাক্ষ করেছিলেন। সুজেটের চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন সে সময় মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের বৃত্তে থাকা মন্ত্রী মদন মিত্রও।
শাসদ দলের নেতা ও পুলিশ কর্তা মুখ্যমন্ত্রীর সুরে নানা ভাবে সুজেটকে বিঁধলেও, এক পুলিশ অফিসার অবশ্য ঘটনার তদন্ত চালিয়ে গিয়েছেন। সাজানো ঘটনার তত্ত্ব নস্যাৎ করে গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনই প্রথম জানিয়েছিলেন, সুজেটকে গণধর্ষণই করা হয়েছে। তাঁর উদ্যোগেই ধরা হয় তিন অভিযুক্তকে। এর পরে দময়ন্তীকে মহাকরণে ডেকে পাঠানো হয়। মু্খ্যমন্ত্রীর ঘর থেকে থমথমে মুখে বেরিয়ে কার্যত মুখে কুলুপ আঁটেন দময়ন্তী। এর কিছু দিন পরে তিনি বদলি হয়ে যান ব্যারাকপুরের পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।
এই প্রক্ষাপটে এ দিন এই মামলার রায় কী হয়, তা জানার জন্য আগ্রহ ছিল সব মহলেরই। সকাল থেকেই আদালত চত্বরে ভিড় জমতে শুরু করে। সকাল দশটা নাগাদ আদালতে নিয়ে আসা হয় অভিযুক্তদের। প্রায় দু’ঘণ্টা লকআপে থাকার পর তাদের তোলা হয় বিচারভবনের দোতলায় ফাস্ট ট্র্যাক সেকেন্ড কোর্টের বিচারক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের এজলাসে। অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী অশোক বক্সী, লোকেশ ভট্টাচার্য ছাড়াও তখন এজলাসে সাংবাদিক, অভিযুক্তদের আত্মীয় এবং অন্য আইনজীবীদের ঠাসাঠাসি ভিড়। পরিস্থিতি দেখে বিচারক আইনজীবী ছাড়া সকলকেই এজলাস থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। পরে রুদ্ধদ্বার কক্ষে রায় ঘোষণা করেন তিনি।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, বিচারক তাঁর বলেছেন, ‘‘এই গণধর্ষণের মামলায় তিন ধৃত অভিযুক্ত নাসের খান, রুমান খান এবং সুমিত বজাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।’’ সরকারি আইনজীবী অমলেন্দু চক্রবর্তী জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের তিন জনকেই ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ (২) (জি) ধারায় দোষী ঘোষণা করেছেন বিচারক। রুমান খান এবং নাসের খান ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৬,৩২৩,১২০ (বি), ৩৪ ধারায় দোষী প্রমাণিত হয়েছে। আইনজীবীদের বক্তব্য, দোষীদের দশ বছর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
কিন্তু কী হবে ফেরার কাদের খান ও আলির?
আইনজীবীদের বক্তব্য, ধরা পড়লে ওই দু’জনের বিরুদ্ধে ফের অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করতে হবে পুলিশকে। ওই চার্জশিট অনুযায়ী, ওই দু’জনের জন্য নতুন করে শুনানি শুরু করা হবে।
বিচারক এ দিন তাঁর রায় ঘোষণার পরে সুজেটের বোন নিকোলা বলেন, ‘‘রায়ে আমরা খুব খুশি।’’ এর পরেই তাঁরা চলে যান ভবানীপুরের গোরস্তানে। সেখানে সুজেটের কবরের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর পরিবার।
আদালতেও অবশ্য দেখা যায় কান্নার দৃশ্য। বিচারক নিজের আসন থেকে উঠে যেতেই কাদেরের ভাই নাসের এবং সুমিত বাজাজ চোখের জল মুছতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতেই সুমিত তার পরিবারের লোকেদের বলতে থাকে, ‘‘আব হামলোগ দোষী বনচুকা হু।’’ সুমিতকে তার বাবা বলেন, ‘‘ঘাবড়ানা মত, হাম ইসবার হাইকোর্ট যায়েঙ্গে।’’
এই দু’জন যখন ভেঙে পড়েছে কান্নায়, তখন আর এক দোষী রুমান খান অবশ্য শান্ত মুখে তার পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়েছে। মুখে কয়েক দিনের না কাটা ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, ডেনিম শার্ট পরা রুমান খান পরিবারের এক সদস্যকে বলেছে, ‘‘আব আপ লোগোকো হাইকোর্ট জানা চাহিয়ে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy