সুব্রত রায়ের স্বপ্ন বাংলা হোক শিল্পের ভূমি। নিজস্ব চিত্র।
বাংলায় তখন জোর কদমে স্বাক্ষরতা অভিযান চলছে। ১৯৯১-’৯২ সাল নাগাদ নিরক্ষরতা দূরীকরণ আন্দোলনের স্লোগান ছিল ‘চলো পড়াই, কিছু করে দেখাই।’ মূলত বামপন্থী কর্মীদের এই স্লোগানের একটা পাল্টাও তৈরি হয়েছিল। এই কর্মসূচির মাধ্যমে টাকা তোলার অভিযোগ করে পাল্টা স্লোগানে বলা হয়েছিল, ‘চলো পড়াই, কিছু করে খাই!’
কিন্তু পড়িয়ে ‘করে খাই’ আর কটাক্ষ নয়। বরং এটাই মন্ত্র বাংলায় শুরু হওয়া নতুন ব্যবসা অনলাইন টিউশন অ্যাপ নির্মাণকারীদের। ২০২১ সালের সরস্বতী পুজোয় বাজারে আসা টিউটোপিয়া সংস্থার কর্ণধার সুব্রত রায় বলছেন, সমাজসেবা নয়, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলায় নতুন শিল্প সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে তাঁর তৈরি অনলাইন প্রাইভেট টিউশন পদ্ধতি। সংস্থার হিসেব মতো শুধু শিল্প নয়, লাভজনক বড় শিল্প হিসেবে সাফল্য মেলার ইঙ্গিত সংস্থার বয়স এক বছর হওয়ার আগেই মিলতে চলেছে। তাই ‘করে দেখাই’ ভাবনাও রয়েছে সুব্রতের। তাঁর প্রধান ব্যবসা অ্যানিমেশন ক্ষেত্রের পাশাপাশি অনলাইন টিউশন ব্যবস্থার বাণিজ্য-কেন্দ্র হিসেবেও পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার পরিচয় তৈরি করার স্বপ্ন দেখেন সুব্রত।
একটা সময় পর্যন্ত ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালানো সুব্রত কোনও দিনই অবশ্য টিউশন ঘিরে এমন বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখেননি। মাথাতেও আসেনি। টিউটোপিয়া গঠনের গল্প শুনলে বোঝা যায় করোনা পরিস্থিতিই তৈরি করে দিয়েছে এমন সম্ভাবনাময় ব্যবসার ভিত। সুব্রতর জীবন শুরুর কাহিনিতেও বড় কিছু হয়ে ওঠার পূর্বলক্ষণ ছিল না। বাবা সুভাষ রায় ছিলেন বেসরকারি চাকুরে। সেটিও সুদূর কাশ্মীরের একটি সংস্থায়। শীতের সময়ে বাড়ি আসতেন আর ফি মাসে পাঠাতেন মানি অর্ডার। কিন্তু সেই পাঠানো টাকার পরিমাণ এতটা ছিল না যে, ছয় সন্তান নিয়ে নিশ্চিন্তে সংসার চালিয়ে ফেলবেন সুব্রতর মা আরতি। উপায় নেই বলেই একটা সময়ে টালিগ়ঞ্জের উকিলপাড়ার বাসিন্দা আরতিদেবী এলাকার সেলাই দিদিমণি হয়ে ওঠেন। সেলাই শিখিয়ে বড় করেন ছেলেমেয়েদের। সকলেই এখন প্রতিষ্ঠিত। সুব্রতের মতো তাঁর ভাইও ব্যবসায়ী। চার দিদির কেউ শিক্ষিকা, কেউ ব্যঙ্ককর্মী, কেউ স্বাস্থ্যকর্মী।
টালিগঞ্জের উকিলপাড়া থেকে একটা সময় হরিদেবপুরে ভাড়া উঠে যান সুব্রতরা। এর পর সাউথ সিটি কলেজের কমার্সের ছাত্র সুব্রত টিউশন পড়াতে শুরু করেন। কমার্সের ম্যাথ-স্ট্যাট-ইকনমিক্স কম্বিনেশনের প্রাইভেট টিউটর এর পরেই নিজের কোচিং সেন্টার খুলে ফেলেন হরিদেবপুরে। প্রায় সব বিষয়ের শিক্ষকেরা ছিলেন তাঁর সঙ্গে।
কিন্তু তাতে নতুন এক অস্বস্তি তৈরি হয় সুব্রতের মনে। সকাল ১০টা বাজলে সবাই যখন কাজে, তখন তাঁর অখণ্ড অবসর। প্রাইভেট টিউটরদের ছুটির সময়। আবার সন্ধেয় যখন সবার অবসর, তখন তাঁর কাজের সময়। মাঝের সময়টুকু কী করা যায় ভেবেই শিখতে শুরু করেন অ্যানিমেশন। তা-ও কোনও প্রথাগত প্রশিক্ষণ নয়। এ দিকে-ও দিক গিয়ে সেই পেশায় যুক্তদের কাছে হাতেকলমে।
ভেবেছিলেন সকাল-সন্ধ্যা টিউশনি আর বাকি সময়টা অ্যানিমেশনের কাজ পেলে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা পোক্ত হবে। কপালক্রমে বিয়ে করলেন যাঁকে, সেই সঞ্চয়িতা সুব্রতর থেকে শিল্পী হিসেবে অনেক এগিয়ে। স্ত্রীকে নিয়ে শুরু হল নতুন কাজ। বিভিন্ন সংস্থার জন্য অ্যানিমেশন বানানো আর নতুনদের শেখানো। বছর বিশেক ধরে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে চালাচ্ছেন ‘হাইটেক অ্যানিমেশন’ নামে সংস্থা। বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় অ্যানিমেশন বানানোর কাজ করেছেন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের জন্য। সেই সঙ্গে শুরু করেন একটি শিক্ষা সর্বভারতীয় সংস্থার এডুকেশন অ্যাপের বিভিন্ন উপাদান তৈরির কাজ। কিন্তু অতিমারি করোনার জেরে সেই কাজ আচমকাই বন্ধ হয়ে যায়। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে একদল কর্মীর ভবিষ্যৎ।
আবার সেই করোনাই খুলে দেয় অন্য এক ভাবনার জানলা। বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করে, এমন স্কুলপড়ুয়াদের জন্য একেবারে বাংলার জন্য একটা অ্যাপ বানালে কেমন হয়? একই ভাবনা তৈরি হয় বন্ধু তথা ব্যবসার সঙ্গী অনুরাগ চিরিমারের মধ্যে। ভাবনার আদান প্রদানের মধ্যে দিয়েই তৈরি হয় টিউশন নিয়ে এক ‘ইউটোপিয়া’ (কল্পলোক) তৈরির ভাবনা। সেই ভাবনার অঙ্কুর বীজ হয়ে জন্ম দেয় টিউটোপিয়ার।
যদিও বাংলাকে ভালবাসা সুব্রতের একটাই আক্ষেপ, অ্যাপের জন্য ভাল একটা বাংলা নাম পাননি। যা মাথায় এসেছিল, সবই নাকি আগে থেকে কেউ দখল নিয়ে রেখেছে! তবে ‘টিউটোপিয়া’ নাম নিয়ে এখন খুশি তিনি।
এমন অ্যাপ অবশ্য নতুন নয়। সিবিএসই বা আইএসএসই পাঠ্যক্রমের জন্য আগেই অনেক সংস্থা অ্যাপ বানিয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে অনেক অ্যাপ ও অনলাইন টিউশন মাধ্যম ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়। কিন্তু মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পাঠ্যক্রম মেনে অ্যাপ এই প্রথম! আসলে সুব্রত ভেবেছিলেন, দিল্লি বোর্ডের জন্য তো অনেক কিছু হয়েছে। এ বার বাংলা বোর্ডের জন্য কিছু হোক। পাশাপাশিই ভেবেছিলেন, ফার্স্ট বেঞ্চের পড়ুয়াদের জন্য না ভেবে বরং সংখ্যায় অনেক বেশি মধ্যমেধার পড়ুয়াদের কথা ভাবা যাক। বাজারটাও বড় আর তারাও এগিয়ে আসার সাহস দেখাতে পারবে। সর্বভারতীয় অ্যাপগুলির তুলনায় অনেক কম খরচে বাংলার পড়ুয়ারা লেখাপড়ার সুযোগ পায়। আর সেই পড়ুয়ার সংখ্যাও তো নেহাত কম নয়।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ।
এখন টিউটোপিয়ার স্লোগান— ‘দুনিয়া যেভাবে পড়ে, বাংলার ঘরে ঘরে।’ আরও ভেঙে বাংলার সব বড় শহরের নামেই তৈরি হয়েছে স্লোগান। সেখানে হংকংয়ের পাশে হাওড়া, সিডনির পাশে সিউড়ি। প্রতিষ্ঠিত, অভিজ্ঞদের পাশাপাশি কয়েক হাজার তরুণ শিক্ষককে সঙ্গে নিয়েছেন সুব্রত। তাঁরাই অ্যাপের জন্য পাঠ্যক্রম তৈরি করেন, তাঁরাই কোনও পড়ুয়ার প্রশ্ন থাকলে অনলাইনে জবাব দেন।
তবে একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে টিউটোপিয়ার শিক্ষকদের। একটা সময় পর্যন্ত কার্টুন কাহিনি তৈরি করা সংস্থার রীতি মেনে সবই করেন গল্পের আকারে। এর পিছনে তথাকথিত অমনোযোগী পড়ুয়াদের টানার ভাবনাও রয়েছে। সে সব বুঝতে গেলে অবশ্য অ্যাপ নেড়েচেড়ে দেখতে হবে। জানালেন সুব্রত। ওই অ্যাপে নাকি অনলাইনে পড়ার পাশাপাশি শিক্ষকের সামনাসামনি বসে ক্লাস করার মতো অভিজ্ঞতাও সম্ভব। একজন পড়ুয়ার প্রশ্নের উত্তর জানতে পারে বাকি সকলে। আবার পুরনো পড়া ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগও রয়েছে। চাইলে অ্যাপে নিয়মিত পরীক্ষাও দেওয়া যায়। সুব্রতের কথায়, ‘‘টিউশনের সব রকম কল্পলোক বা ইউটোপিয়াকে বাস্তব করা যায় আমাদের এই অ্যাপে। আগামী দিনে সেটা আরও উন্নত হবে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ফিচার যুক্ত হয়ে চলেছে। এখন অষ্টম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণির পড়ুয়ার জন্য পাঠ্যক্রম রয়েছে। আগামী দিনে বাংলা মাধ্যমের সপ্তম থেকে দ্বাদশের পড়ুয়াদের নিজেদের অ্যাপ হয়ে উঠবে টিউটোপিয়া।’’
শহরে বা গ্রাম বাংলায় হাজার হাজার প্রাইভেট টিউটরদের কি তবে দুর্দিন আসছে? সুব্রতর সহাস্য জবাব, ‘‘না, সে ভয় নেই। অলনাইন যতই জনপ্রিয় হোক, অফলাইন যুগ যুগ ধরে থেকে যাবে। আর অনেক শিক্ষকও টিউটোপিয়া দেখে নিজেদের আরও পারদর্শী করে তুলছেন।’’
করোনা পরিস্থিতি তো তার মানে টিউটোপিয়ার কাছে আশীর্বাদ! যতদিন এই পরিস্থিতি থাকবে ততদিন তাঁদের ব্যবসার পক্ষে ভাল? এর পরে কী করবেন? প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়েই সুব্রত বললেন, ‘‘এটা ভুল ভাবনা। এখন স্কুল-কলেজ বন্ধ বলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে লেখাপড়া নিয়ে ভাবনা অনেকটাই কম। যে-ই পুরনো অবস্থা ফিরবে অমনি টিউটোপিয়ার উপরে ভরসা আরও বাড়বে। অফলাইনে পরীক্ষা চালু হলে ছেলেমেয়েদের টিউশনে নির্ভরতা বাড়বে। এটা ক্রমশ অভ্যাস হয়ে উঠবে। আর মাসিক মাত্র ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ করে সব বিষয়ের উন্নত মানের টিউশন কোথায় মিলবে? রাজ্যের যে কোনও প্রান্তে বসে সেরা শিক্ষকদের পরামর্শ, ভিডিয়োর মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া, নোটস, পড়া ঝালানোর সুযোগ পাওয়াটা খুব সহজ নয়। সেই কঠিন কাজটাই আমরা সহজ করে দিচ্ছি।’’
সুব্রত জানালেন, তাঁদের অ্যাপ ইতিমধ্যেই গুগল প্লে স্টোরে ৫-এ ৪.৮ র্যাঙ্কিং পেয়েছে। ১৭ হাজারের বেশি রিভিউ। জানুয়ারির মাঝামাঝিতেই অ্যাপ আট লাখের বেশি ডাউনলোড হয়ে গিয়েছে।
ব্যাঙ্ককর্মী দিদির সূত্রে একটি ঋণ পেয়ে ১৯ হাজার টাকা দিয়ে কম্পিউটার কিনেছিলেন যুবক সুব্রত। আজ হাজার হাজারে যুবক তাঁর কিনে দেওয়া কম্পিউটার দিয়ে ছাত্র পড়ান। স্ত্রী সঞ্চয়িতা দেখেন পুরনো অ্যানিমেশনের ব্যবসা। সদ্য কলেজে ঢোকা কন্যা আরুষী বাবার অ্যাপ ব্যবসায় যুক্ত হয়ে গিয়েছেন। সুব্রতের কথায়, আমার সন্তান হোক বা কর্মী— যারাই এখানে রয়েছে, তারা নিরন্তর লেখাপড়ার চর্চায় রয়েছে।
ইংরেজির ‘ইউ’ শব্দের মতো কিছু নেই বাংলায়। যা দিয়ে ‘তুই’, ‘তুমি’, ‘আপনি’— সব বোঝানো যায়। তবে ‘তুমি’ শব্দটিই টিউটোপিয়ার পছন্দের। এই অ্যাপের সব সম্বোধনই তাই ‘তুমি’। ঠিকই। অ্যাপের ইউজার, গ্রাহক সকলেই তো পড়ুয়া। সকলেই তো প্রিয় ছাত্রছাত্রী। মনে করে টিউটোপিয়া। আর স্বপ্ন দেখানো এবং স্বপ্নদ্রষ্টা সুব্রত বলেন, ‘‘দু-পাশেই পড়ুয়া। আমরাও তো শেখাতে শেখাতে আসলে শিখছিই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy