Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Bowbazar

হাত ধরার মানুষ নেই, বরং মানুষই পাতছে ফাঁদ

বৌবাজারের সত্তরোর্ধ্ব মানুষটির স্ত্রী প্রয়াত হয়েছেন। ছেলে আর পুত্রবধূর বাস দুই আলাদা জায়গায়।

—প্রতীকী ছবি

—প্রতীকী ছবি

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:২৯
Share: Save:

বৌবাজারে বৃদ্ধ খুন, যাদবপুরের আবাসনে এক প্রবীণের নিথর দেহ অথবা হাসপাতালের জানলায় লোলচর্ম বৃদ্ধার মুখ, যাঁর থেকে মুখ ফিরিয়েছে পরিবার— আপাত ভাবে প্রতিটি ঘটনাই আলাদা। কিন্তু অন্তর্লীন মিল একাকিত্ব। যা একই সঙ্গে সামাজিক অসুখ এবং হন্তারকও। ‘মানুষ বড় একলা’ আর ‘তাহার’ পাশে এসে দাঁড়ানোর লোকজনও খুব নেই তেমন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরাও আবার একা। এক জটিল বিষয়। একাকিত্ব নানাস্তরীয়। ধনীর একাকিত্ব আর নির্ধনের একাকিত্ব, প্রেমিকের একাকিত্ব আর বিবাহ-বিচ্ছিন্নের একাকিত্ব, কর্মপ্রাণ মানুষের আর কর্মহীনের একাকিত্ব কিংবা অবৈজ্ঞানিক আর বিজ্ঞানীর একাকিত্বের রসায়ন আপাত ভাবে এক নয়। কিন্তু কোথাও আছে কোনও মিল। আর সেই মিলের কারণেই ভিতর থেকে পরিসর কমে আসছে সংসারের, সমাজের এবং বৃহত্তর অর্থে দেশ-পৃথিবীর। এক অন্ধকারের সুযোগ নিচ্ছে অন্য অন্ধকার।

বৌবাজারের সত্তরোর্ধ্ব মানুষটির স্ত্রী প্রয়াত হয়েছেন। ছেলে আর পুত্রবধূর বাস দুই আলাদা জায়গায়। অবিবাহিত, মধ্যবয়সি মেয়ে থাকতেন বৃদ্ধের সঙ্গে। তাঁর বেসরকারি চাকরি। অনেকটা সময় একাই থাকতেন বৃদ্ধ। একাকিত্ব কি গ্রাস করেছিল তাঁকে? উত্তর জানা কঠিন। যেটুকু জানা গিয়েছে, তিনি খুন হয়েছেন। কিন্তু খুন কি একা থাকারই সুযোগ নিয়ে? ভাবনা অমূলক নয়। কলকাতা শহরের বহু ঘটনায় দেখা গিয়েছে, এক অন্ধকারের সুযোগ নিয়েছে অন্য অন্ধকার। একা থাকার সুযোগ নিয়েছে বন্ধু, পরিচারক, নির্মাণকর্মী, পাড়ার দাদা, রাজনৈতিক কর্মী, এমনকি পরিজনও। সমস্যা হল, গৃহকর্মে সাহায্যকারী বা রঙের মিস্ত্রির পরিচয়পত্র জোগাড় করা গেলেও দূরবর্তী দ্বীপের পরিজনের পরিচয়পত্র জোগাড় করেই বা কী লাভ! সরষের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ভূতকে সরষের মতোই দেখতে লাগে।

বয়স্ক বাবাকে একা রেখে দূরের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার আগে পোষা কুকুরকে বাড়িতে রেখে যাচ্ছেন ছেলে। কিছু দিন পরে কুকুরটিকে পাওয়া যাচ্ছে হাত-পা বাঁধা অবস্থায়, ঘরে মিলছে প্রবীণ মানুষটির দেহ। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে মায়ের ভার দিয়ে সন্তান বিদেশে নিশ্চিন্তে, আর সন্তানকে ছেড়ে থাকার বেদনা ঘুণপোকার মতো বাসা বাঁধছে মায়ের মনে। সেই অসহায়তা সামাজিক ভাবে যখন প্রকাশ পাচ্ছে, তখন সুযোগ নেওয়ার লোকের অভাব ঘটছে না।

আরও খবর: বউবাজারে বৃদ্ধ খুন, মাথায় বাড়ি প্রেসার কুকারের, গলায় ধারালো ছুরির কোপ

আরও খবর: পলাতক অভিযুক্তদের তালিকা চাইল নির্বাচন কমিশন

লকডাউন অবসাদ বাড়িয়েছে। আবার, একই সঙ্গে যা ছিল একাংশের, তার মূল কাঠামোটিকে প্রকট করেছে। মন:সমাজকর্মী মোহিত রণদীপের কথায়, ‘‘সম্পর্কে দায়বদ্ধতার ঘাটতি বাড়ায় অপরাধ ইন্ধন পাচ্ছে। গড় আয়ু বেড়েছে, বেড়েছে একাকিত্বও। সমস্যা হল, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সামাজিক বাঁধনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।’’ সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় মনে করছেন, ‘‘একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়া, পাড়া-সংস্কৃতি ভেঙে পড়া একাকিত্বের প্রধান কারণ। তাই নাগরিক মঞ্চ, স্থানীয় ক্লাবের উপরে অনেকটাই দায়িত্ব বর্তাচ্ছে। তাদের মারফত বয়স্কদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।’’

কমে যাচ্ছে সহায়তার হাত। বাড়ছে একাকিত্ব। বাড়ছে অপরাধপ্রবণতাও। এবং এই অপরাধের ‘মাছের চোখ’ অসহায় মানুষজন। শুধু বয়স্করাই যে আছেন, তা নয়। আছে শিশু, আছেন মহিলারাও। অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এটা বুঝেই যে, প্রতিবাদ করার বা পাশে থাকার লোকজন নেই। এই শূন্যতাই সর্বগ্রাসী। শূন্যের ধর্মই ছড়িয়ে পড়া, গ্রাস করা।

‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে হোটেলের ছাদের গান ‘বড় একা লাগে এই আঁধারে’ এখন যেন আর রোম্যান্টিক বিষণ্ণতাই তৈরি করে না শুধু, ভয়ও দেখায়। কারণ, একাকিত্বের অন্য নাম ভয়।হাত ধরার মানুষ নেই, বরং মানুষই পাতছে ফাঁদ।

অন্য বিষয়গুলি:

Bowbazar Jadavpur All Alone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy