ফুলের টব ছুড়ে ভাঙা হচ্ছে কাচের দরজা। বুধবার কলকাতার সিএমআরআই হাসপাতালে। নিজস্ব চিত্র
মাটিতে আছড়ে ফেলা হচ্ছে কম্পিউটার। লোহার রডে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ফুলের টব। চুরমার হয়ে সশব্দে খসে পড়ছে কাচের দরজা-জানলা। এক দল লোক বেধড়ক পেটাচ্ছে হাসপাতালের রিসেপশনের কর্মী আর নিরাপত্তারক্ষীদের। সঙ্গে অকথ্য গালিগালাজ। অন্য কর্মীরা যে যে দিকে পারছেন, পালাচ্ছেন। আতঙ্কিত রোগীরা সিঁটিয়ে রয়েছেন এখানে-ওখানে।
বুধবার সকাল। তাণ্ডব চলছে কলকাতার সিএমআরআই হাসপাতালে। ১৬ বছরের এক রোগিণীর মৃত্যুর জেরে।
হাসপাতালের বিরুদ্ধে মৃতার পরিবারের অভিযোগ গুরুতর। তাঁদের দাবি, পেটের ব্যথায় ছটফট করতে থাকা ওই কিশোরী সায়েকা পরভিনকে মঙ্গলবার রাতে হাসপাতালে আনার পর তার অস্ত্রোপচারের জন্য দেড় লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন সিএমআরআই কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই টাকা জোগাড় না হওয়ায় খিদিরপুরের ভূকৈলাস রোডের বাসিন্দা সায়েকাকে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয়েছিল বলে তাঁদের দাবি। এমনকী কখন সায়েকার শারীরিক অবস্থার অবনতি শুরু হল, হাসপাতালে তার কী চিকিৎসা হল বা আদৌ হল কি না— কিছুই নাকি জানানো হয়নি পরিবারকে। মৃত কিশোরীর দাদা জানিয়েছেন, শেষে এক রকম জোর করেই আইসিইউয়ে ঢুকে তাঁরা দেখেছিলেন, সায়েকা আর বেঁচে নেই।
হাসপাতালের কর্মীদেরই একাংশ জানিয়েছেন, রাতের কর্তব্যরত ডাক্তার-নার্সরা কোনও প্রশ্নেরই যথাযথ জবাব না দেওয়ায় উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন সায়েকার বাড়ির লোকজন। অভিযোগ, গোড়ায় আইসিইউ-এ ঢুকতে বাধা দেওয়া হলে ঘুষি মেরে কাচ ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন সায়েকার দাদা মহম্মদ জাহির। নিরাপত্তারক্ষীরা তখনকার মতো পরিস্থিতি সামলান। কিন্তু সকাল হতে না হতেই হাসপাতাল চত্বরে ভিড় বাড়তে থাকে। ৯টা নাগাদ কয়েকশো লোক জড়ো হয়ে দাবি করতে থাকেন, রাতে সায়েকার চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন যে ডাক্তারেরা, তাঁদের সামনে আনতে হবে। এ বার রক্ষীরা বাধা দিতে গেলে শুরু হয় বেধড়ক মারধর। সঙ্গে ভাঙচুর।
ভাঙুচরের পর হাসপাতালের রিসেপশন। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
কার্যত হামলাকারীদের মুক্তা়ঞ্চলের চেহারা নেয় সিএমআরআই। বন্ধ হয়ে যায় রোগী ভর্তি, ইমার্জেন্সি-সহ অধিকাংশ পরিষেবা। আতান্তরে পড়েন দূর থেকে আসা অসংখ্য রোগী ও তাঁদের পরিবার। সেই সঙ্গে চলতে থাকে দফায় দফায় রাস্তা অবরোধ। এই ঘটনায় বুধবার সন্ধে পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা না হলেও হাসপাতালের সিসিটিভি-র ছবি দেখে দশ জন যুবককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে লালবাজার সূত্রে খবর। পুলিশকর্তাদের একাংশ জানিয়েছেন, সায়েকার বাড়ি যেখানে, সেই ভূকৈলাস রোডের বাগকুটি এলাকার বাসিন্দারাই হাসপাতালে চড়াও হয়েছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিল মূলত স্থানীয় দুই যুবক শেখ সাকিল এবং আবতাব। পুলিশের যুক্তি, ভাঙচুরের সময়ে কাউকে গ্রেফতার করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারত। তবে হামলাকারীদের অধিকাংশকেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
চিকিৎসায় গাফিলতির যে কোনও অভিযোগে হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনা কার্যত জলভাত হয়ে গিয়েছে এ রাজ্যে। এমন ঘটনা রুখতে সাত বছর আগে আইন পাশ হলেও তাতে পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি। এমনকী এই আইনের প্রয়োগ করে অপরাধীদের শাস্তির নজিরও খুব বেশি তৈরি হয়নি। যদিও সেই আইনেই মঙ্গলবার সন্ধেয় আলিপুর থানায় এফআইআর দায়ের করেছেন হাসপাতালের সিইও।
ঘটনার সময়ে হাসপাতালে হাজির রোগীদের পরিবারের কেউ কেউ সায়েকার আত্মীয়দের অভিযোগ সম্পর্কে সহানুভূতিশীল হলেও এ ভাবে হামলা এবং ভাঙচুরের নিন্দা করেছেন তাঁরা। বিশেষত চিকিৎসার সঙ্গে আদৌ যোগ না থাকা রিসেপশন কর্মী বা নিরাপত্তারক্ষীদের যে ভাবে পেটানো হয়েছে, সমালোচনা হয়েছে তারও। সায়েকার পরিজনদের অবশ্য দাবি, পরিকল্পনা করে হামলা হয়নি। যে ভাবে ওই নাবালিকার মৃত্যু হল, তা মেনে নিতে না পারার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াতেই এমনটা ঘটে গিয়েছে।
সায়েকার বাবা মহম্মদ কামালের দাবি, মঙ্গলবার রাতে মেয়েকে হাসপাতালে আনার কিছুক্ষণ পরেই তাঁদের বলা হয়, অপারেশন করতে হবে। দেড় লক্ষ টাকা দরকার। কীসের অপারেশন, সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। কামালের কথায়, ‘‘এক সঙ্গে অত টাকা তখনই জোগাড় করতে পারিনি। চেষ্টা-চরিত্র করে কয়েক ঘণ্টা পরে ৪০ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে হাসপাতাল থেকে বলা হল, আমার মেয়ের অবস্থা নাকি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, অপারেশন করা যায়নি। বুঝতেই পেরেছি চিকিৎসা না করে ফেলে রেখেই মেয়েটাকে মেরে ফেললেন এখানকার ডাক্তারেরা।’’
আরও পড়ুন: তাণ্ডব নিন্দার, প্রশংসা পাচ্ছে না পরিষেবাও
আশ্চর্যের কথা হল, হাসপাতাল কর্মীদের একাংশ বলেছেন যে, মঙ্গলবার রাতে সায়েকার পরিবারের লোকেদের রাগারাগি করতে দেখেছেন তাঁরা। অথচ এ দিন সরকারি ভাবে সিএমআরআই কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, মঙ্গলবার রাতে নাকি হাসপাতালে আনাই হয়নি ওই কিশোরীকে! অন্য রোগীদের কয়েক জন আত্মীয় জানিয়েছেন, সায়েকাকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল মঙ্গলবার রাত ৯টা নাগাদ। সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, তাকে আনা হয়েছিল বুধবার ভোরে। হাসপাতালের জনসংযোগ আধিকারিক পিয়াসী রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘খুবই খারাপ অবস্থায় মেয়েটিকে আনা হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে ডাক্তারদের সন্দেহ ছিল, ‘পারফোরেশন অব বাওয়েল’। মেয়েটি শক-এ ছিল। আমরা রক্তচাপ স্বাভাবিক করার ওষুধ দিই। কারণ রক্তচাপ স্বাভাবিক না হলে অস্ত্রোপচার করা যেত না। দুর্ভাগ্যক্রমে শক কাটার আগেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ।’’
বাড়ির লোকেদের বক্তব্য, মঙ্গলবার সন্ধের আগে সায়েকার তেমন কোনও অসুস্থতাই ছিল না। রাত ৯টা নাগাদ অসহ্য পেটব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আনা হয়েছিল তাকে। দাদা জাহিরের দাবি, রাত ১২টা পর্যন্ত বোনের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা। রাতে হাসপাতালেই ছিলেন বাড়ির অনেকে। বোনের কী হয়েছে, কী পরীক্ষা হচ্ছে, সে ব্যাপারে তাঁদের কিছুই জানানো হয়নি। জাহির বলেন, ‘‘রাত ৩টেয় আমাদের জানানো হয়, বোনকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওর অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, অপারেশন করা যায়নি। এর বাইরে আমাদের কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেননি ডাক্তাররা। ৩টের কিছু পরে জোর করে আইসিইউ-এ ঢুকে দেখি, বোনের চোখ খোলা। ঠোঁট ফাঁক হয়ে রয়েছে। গোটা শরীর নীল। দেখেই বোঝা গিয়েছিল ওর শরীরে প্রাণ নেই।’’
দুপুরের পরে ভাঙচুর থামলেও উত্তেজনা কমেনি। হাসপাতালের তরফে মাইকে ঘোষণা করে কর্মীদের কাজে যোগ দিতে অনুরোধ করা হয়।
এই সময়েই ফের কিছু লোক হাসপাতালে ঢুকে তাদের হাতে ডাক্তারদের তুলে দেওয়ার দাবি জানালে তৈরি হয় আর এক দফা উত্তেজনা। ফের কিছুক্ষণ রাস্তা অবরোধও হয়। ময়নাতদন্তের জন্য দুপুর আড়াইটে নাগাদ সায়েকার মৃতদেহ নিয়ে হাসপাতাল ছাড়েন বাড়ির লোকেরা।
যদিও আতঙ্ক তখনও হাসপাতালকে ছাড়েনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy