পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের প্রার্থী-তালিকা প্রকাশের পরেই। যা নিয়ে সরব হয়েছিল বাম এবং বিজেপিও। যদিও তাতে পাত্তা দেয়নি তৃণমূলের শীর্ষ মহল। শহরের যে ক’টি বরোয় প্রার্থী নির্বাচনে ‘পরিবারতন্ত্র’ নিয়ে পুরসভার লড়াই জমছে, তারই অন্যতম এই ৬ নম্বর বরো।
কোথাও প্রার্থী বিধায়কের মেয়ে, কোথাও ছেলে, কোথাও আবার কোনও নেতার গৃহিণী। মূলত মধ্য কলকাতার আনন্দ পালিত রোড থেকে ধর্মতলা চত্বরে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এই বরো। সংখ্যালঘুর পাশাপাশি অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকার অনেকেই ভাগ্যনিয়ন্তা এই বরোর পুর-প্রতিনিধি নির্বাচনে। পানীয় জল, নিকাশি নিয়ে কিছু অভিযোগ এলেও হকার সমস্যায় বিরক্ত স্থানীয় মানুষ। ভোটের মুখে তা নিয়ে অবশ্য সব রাজনৈতিক দলই মুখে কুলুপ এঁটেছে। প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছে পরিবারতন্ত্রই।
রাজনীতিতে তেমন জ্ঞানগম্যি না থাকলেও রাজনৈতিক পরিবারের আবহে বেড়ে ওঠা কয়েক জন তরুণ-তরুণী প্রচার শুরু করেছেন জোর কদমে। ৬২ নম্বর ওয়ার্ডে দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর ইকবাল আহমেদের আসন এ বার মহিলা সংরক্ষিত। সেখানে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন তাঁরই মেয়ে, লরেটোর স্নাতক সানা আহমেদ। অভিযোগ, বাবা ইকবালের দাপটে এ বার ওই ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারেনি বিজেপি। তবে বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য মুখে তা স্বীকার করতে চাননি। একটু ঘুরিয়ে সংগঠনের দুর্বলতাকে সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করে দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেছেন, ‘‘এই ওয়ার্ডে আমাদের সংগঠন দুর্বল। তবে ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েমের লক্ষ্যে তৃণমূলের চাপা সন্ত্রাসের জন্য আমরা ওই ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারিনি।”
গত লোকসভা ভোটে ওই ওয়ার্ডে প্রায় চার হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। ইকবালের ওয়ার্ডে তৃণমূলের হার নিয়ে সমালোচনা উঠেছিল দলের শীর্ষ মহলে। সেই ফলাফল বদলে যায় চৌরঙ্গি বিধানসভা উপ-নির্বাচনে। ইকবালের দল জেতে সাত হাজারেরও বেশি ভোটে। জামানত জব্দ হয় বিজেপি-র। মেয়ে প্রার্থী হলেও ওই এলাকার আসল ‘শের’ এখনও ইকবালই। তাঁর হুঙ্কার, ‘‘এখানে তৃণমূলই শেষ কথা।’’
এই ওয়ার্ডেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। সিপিএমের সদর দফতর। সেখানেও প্রচারে অনেকটা পিছিয়ে বামেরা। ওয়ার্ডে সিপিএমের প্রার্থী আলেয়া হোদা, কংগ্রেসের প্রার্থী সাবিউন্নেসা হক খান। পুর-পরিষেবার বদলে পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়েই তাঁরা বেশি সরব। জবাবে ইকবাল-কন্যা সানা আহমেদ বলেন, “দু’দশক ধরে মানুষের সঙ্গে মিশে রাজনীতি করেছি। দিদি তা জানেন বলেই আমাকে পছন্দ করেছেন। এতে পারিবারিক বিষয় নেই।” পুরসভার প্রাক্তন মেয়র পারিষদ সিপিএমের আবু সুফিয়ান বলেন, “আমাদের বোর্ডের আমলে যা কাজ হয়েছে, তার উপরেই প্রলেপ দিয়ে চলেছে তৃণমূল বোর্ড। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতাকে লন্ডন বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। কিন্তু তা হয়নি। এ বার তার জবাব মিলবে।’’
৫২ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী এন্টালির বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহার পুত্র সন্দীপন সাহা। মা সুনীতা সাহা ওই ওয়ার্ডেরই বতর্মান কাউন্সিলর। এ বার ছেলে লড়ছেন ওই আসনে। আইআইএম জোকা থেকে পাশ করা সন্দীপন বহুজাতিক সংস্থার চাকরি ছেড়ে এ বার বাবা-মায়ের মতো রাজনীতিতেই মন দিয়েছেন। ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী রাজেন্দ্র গুপ্ত বলেন, “রাজনীতি তো আর ব্যবসা নয় যে, পারিবারিক পরম্পরায় চলবে। আমাদের লড়াই তার বিরুদ্ধে।”
উত্তরাধিকার সূত্রেই কি রাজনীতিতে? সন্দীপনের জবাব, “দলের কাছে নিজেকে ‘যোগ্য’ প্রমাণ করেছি, তাই মনোনীত হয়েছি। এতে পারিবারিক কোনও বিষয় নেই।” তবে জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত তিনি। যা শুনে ওই ওয়ার্ডের ডিএসপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘শাসক দলের সন্ত্রাসে আমরা তো প্রচারই করতে পারছি না। ভোটে জনগণই আমাদের ভরসা।’’
৫৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তৃণমূলের প্রার্থী প্রাক্তন কাউন্সিলর রাধেশ্যাম সাহার মেয়ে ইন্দ্রাণী সাহা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন প্রাক্তন কাউন্সিলর বিমল সিংহের স্ত্রী সুমন সিংহ। ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী সোনুশ্রী সিংহ বলেন, “রাজনীতিকে যারা পারিবারিক সম্পদ করতে চাইছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই।” এই ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর সঞ্চিতা মণ্ডল।
মধ্য কলকাতার বাম রাজনীতিতে প্রবীণ সিপিএম নেতা মহম্মদ নিজামুদ্দিনের দুই ছেলে এ বার দুই দলের হয়ে ভোটে লড়ছেন। ছোট ছেলে পেশায় ব্যবসায়ী তোঘরাল কামাল ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী। ৬০ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের প্রার্থী আর এক ছেলে মনজর এহসান। তোঘরালের বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী স্থানীয় কাউন্সিলর আমিরুদ্দিন। এন্টালি মার্কেট সংলগ্ন এই ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী আমিরুদ্দিন (ববি) বলেন, “নিজাম সাহেব এ বার কাকে ভোট দিতে বলবেন? মানুষ তো বিভ্রান্ত হবে।’’ ববি মনে করেন, এ বার সিপিএম তাঁকে ওয়াকওভার দিচ্ছে। ছেলেদের নিয়ে এই রাজনীতি প্রসঙ্গে মহম্মদ নিজামুদ্দিন বলেন, “গণতন্ত্রে সবাই নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন। আমি সারা জীবন কমিউনিস্ট পার্টি করছি। তাই আমার পার্টির প্রার্থীকেই ভোট দিতে বলব।”
৬০ নম্বরের প্রার্থী মনজর সিপিএমের জোনাল কমিটির সদস্য এবং লোকাল কমিটির সম্পাদক। বললেন, “বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই আমি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছি।’’ এ বার ওই ওয়ার্ডে বতর্মান কাউন্সিলর গুলজার জিয়াকে সরিয়ে তৃণমূলের প্রার্থী করা হয়েছে কাইজার জামিলকে। তা নিয়ে রীতিমতো চর্চা শুরু হয়েছে লিন্টন স্ট্রিট, বেনিয়াপুকুরের বাসিন্দাদের মধ্যে। বিজেপি প্রার্থী রমেশ সিংহ বলেন “আগের কাউন্সিলর এত দুর্নীতি করেছেন যে, তাঁকে টিকিটই দেওয়ার সাহস পেল না তৃণমূল। এটাই হবে আমাদের প্রচার।” তবে এ নিয়ে মুখ খোলেননি গুলজার। তাঁর বক্তব্য, “দিদি যা ভাল বুঝেছেন, করেছেন। আমি দিদির পাশেই আছি।’’ তৃণমূল প্রার্থী কাইজার জামিল অবশ্য বলেন, “দুর্নীতি বা কোন্দলের অভিযোগ উঠলেই তো হবে না। প্রমাণ করতে হবে। সংরক্ষণ উঠে যাওয়ায় দল আমাকে প্রার্থী করেছে।” তা হলে গুলজার জিয়াকে মহিলা সংরক্ষিত কোনও আসনে প্রার্থী করা হল না কেন? এর জবাব কাইজার দেননি।
মল্লিকবাজারের প্রবীণ বিজেপি নেতা নির্মল সিংহ আবেদন জানালেও তাঁকে এ বার টিকিট দেয়নি বিজেপি। সেই ক্ষোভেই তাঁর ছেলে বিনয় সিংহ এ বার নিজের অনুগামীদের নিয়ে ৬১ নম্বরের তৃণমূল প্রার্থী মনজর ইকবালকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছেন। বিজেপি প্রার্থী রাজকুমার শা জানিয়ে দেন টিকিট না পেয়েই ছেলেকে তৃণমূলে ভিড়িয়েছেন নির্মলবাবু। এ দিকে, নির্মলবাবুদের সমর্থন পাওয়ার পরে মনজর বলেন, “আমার বিরোধী সমস্ত প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।”
তবে ত্রিফলা কেলেঙ্কারি এই এলাকার ভোটে প্রভাব ফেলেছে। কারণ তৃণমূল প্রার্থী মনজর ইকবাল আলো দফতরের মেয়র পারিষদ ছিলেন। স্বভাবতই তাঁর ওয়ার্ডে বিরোধীরা ত্রিফলা কেলেঙ্কারির কথাই বেশি করে তুলে ধরছেন। ওই অভিযোগের জবাবে মনজর অবশ্য বলছেন, “এ সমস্তই পুরো বানানো গল্প। ভোটে ইস্যু হবে না।” মনজরের ওই দাপটের মধ্যে লড়াই করছেন কংগ্রেস প্রার্থী শেখ সিরাজউদ্দিন। এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, প্রচারেও সমানে পাল্লা দিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘‘ত্রিফলা আলোর কেলেঙ্কারিতে যুক্ত উনি। অহঙ্কারই এ বার ওঁর পতনের কারণ হবে।”
দীর্ঘদিনের সিপিএম কাউন্সিলর শীলা কপূর ওয়ার্ড সংরক্ষণের কারণে এ বার আর দাঁড়াননি। তাঁর বদলে ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের প্রার্থী তৃপ্তি দাস সরকার। তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূলের গোপালচন্দ্র সাহা। সমাজবাদী পার্টির হাবিবুর রহমান বিরোধী প্রার্থী হওয়ায় নিজের লড়াই নিয়ে খানিকটা স্বস্তিতেই রয়েছেন দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের প্রার্থী অরুণ দাস। ভোটের ঠিক আগেই কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন অরুণবাবু। বিজেপির দিলীপ রাম কি তাঁকে বেগ দিতে পারে? বিরোধীদের মতে, ভোট নিরুপদ্রব হলে অনেক আসনের ফল ভাবাবে তৃণমূলকে। যা শুনে অরুণবাবুর জবাব, ‘‘গল্পের গরু তো গাছেও চড়ে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy