এ যেন দেড় বছর আগের ঘোষণার ‘অ্যাকশন রিপ্লে’।
দেড় বছর আগে সূর্য সেন স্ট্রিট বাজারে আগুনের পরে মুখ্যমন্ত্রী যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার কম-বেশি সেটারই পুনরাবৃত্তি করলেন দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান। এবং শহরে বারবার আগুনের বিপদ সত্ত্বেও রাজ্য প্রশাসন তথা দমকল যে কিছুই করে উঠতে পারে না, সেটা নিজেই কার্যত পরিষ্কার করে দেখিয়ে দিলেন তিনি।
চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালের আগুনের পটভূমিতে নবান্নে এ দিন দমকলমন্ত্রীর ঘোষণা, “অফিস, শপিং মল বা বাজারে রাতবিরেতে যত্রতত্র রান্নাবান্না বা ঘুমোনো এ বার থেকে বন্ধ!” এ সব কাজকর্মের জন্য বাজার-চত্বর বা অফিসবাড়িতেই নির্দিষ্ট নিরাপদ অঞ্চল চিহ্নিত করা হবে বলেও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। শহরের যে কোনও বেসরকারি অফিস, বাজার বা শপিং মলের একতলায় সুরক্ষা সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কন্ট্রোল রুম বসিয়ে তার কাছেই সেখানকার লোকজনের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যান্টিন কিংবা কোনও নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া আগুন জ্বেলে রান্নাবান্নাও করা যাবে না।
পরিকল্পনা রূপায়ণে দমকলের এ যাবত্ কালের তত্পরতা মাথায় রাখলে অবশ্য এ সব ভাবনার প্রয়োগ নিয়ে সন্দেহ থাকছে। রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীই এ দিন কটাক্ষ করেন, “আগে কলকাতায় স্টিফেন কোর্ট, নন্দরাম, আমরি-র মতো অগ্নিকাণ্ড ঘটা সত্ত্বেও দমকল-পুরসভা শিক্ষা নেয়নি।” দমকলমন্ত্রীর এ বারের ঘোষণার ভবিষ্যত্ নিয়ে সংশয় রয়েছে পুর-প্রশাসনের অন্দরেও। পুরকর্তাদের দাবি, সূর্য সেন স্ট্রিট বাজারের আগুনে ১৯ জনের মৃত্যুর পরেই মুখ্যমন্ত্রী এমন ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সফল হয়নি। পুরসভা সূত্রের খবর, তখন ক্যানাল ইস্ট রোড ও চেতলায় বাজারের লোকজনের জন্য দু’টি নৈশ আশ্রয় তৈরি করা হয়। কিন্তু দেখা গিয়েছে, বাজার থেকে দূরে ওই সব জায়গায় কেউ থাকতে রাজি নন। তা ছাড়া, অনেক বাজারেই রাতে বিক্রির সামগ্রী, সব্জি লরিতে করে আমদানি হয়। সে সব জিনিস গোছানোর কাজ চলে গভীর রাত থেকেই। পুরসভার উদ্যোগ বা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ তাই ভেস্তে যায়।
শুধু এটাই নয়, পুর-বাজারগুলোতে নৈশ নিরাপত্তা জোরদার করতে পুর-কর্তৃপক্ষের তরফে কিছু অভিনব পরিকল্পনাও দেখা গিয়েছিল তখন। কিন্তু তাতেও সুবিধা হয়নি। যেমন, সূর্য সেন স্ট্রিট বাজারের অগ্নিকাণ্ডের পরে পুরসভা ঠিক করে, রাতে পুর-বাজারগুলোতে রক্ষীদের ঘুরে ঘুরে কিছু ঘড়িতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর দম দিতে হবে। তা না হলে ঘড়ি বন্ধ হয়ে যাবে এবং প্রমাণ হবে রক্ষী কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন। পরে অবশ্য অন্য রকম প্রযুক্তিতে ওই ঘড়ি ধরে পাহারার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু বাস্তবে সেই অভিনব নজরদারি কার্যকর হয়নি। নিউ মার্কেটে সরকারি সংস্থা ওয়েবেলের সাহায্যে ঘড়িতে দম দেওয়ার ওই প্রযুক্তি চালু হয়েছিল। কিন্তু প্রযুক্তির বিভ্রাটে সব পণ্ড হয়। ফের দরপত্র ডেকে ওই ব্যবস্থা নতুন করে চালুর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন পুরসভার মেয়র পারিষদ (বাজার) তারক সিংহ।
আগে যা চেষ্টা করেও চালু করা যায়নি, সামান্য ঘুরিয়ে অন্য কথা বলে দমকলমন্ত্রী এ দিন ফের সেটাই চালু করার কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, “বাজারে বা অফিস-বাড়িতে আগুনে প্রাণহানি ঠেকাতে রাতের নিরাপত্তা জোরদার করা ছাড়া গতি নেই। যে ভাবে হোক, সেটাই করতে হবে।”
মন্ত্রী তথা দমকলকর্তাদের মত, অনেক ক্ষেত্রেই রাতে বাজার, অফিস বা শপিংমল বন্ধ হওয়ার পরে রক্ষী, দোকানের কর্মচারীরা ভিতরেই স্টোভ জ্বেলে রেঁধেবেড়ে খেয়ে ঘুম দেন। আগুন থেকে বিপদ কখন ঘটল, কেউ টেরই পান না। অনেক ক্ষেত্রেই ঘুমের মধ্যেই আগুনের গ্রাসে পড়েন বাজারে থাকা লোকজন। যতক্ষণে তাঁরা আগুন লেগেছে টের পান, তখন আর পালানোর পথ থাকে না। তাই মন্ত্রীর ঘোষণা, “বাজারে বা মলে কেউ থাকলে একতলায় কন্ট্রোলরুমের পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় থাকতে হবে। রান্নাবান্নাও ক্যান্টিনে সেরে খেতে হবে। রান্নার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থাকবে। তার বাইরে কোথাও আগুন জ্বালা যাবে না!”
কিন্তু কোনও কিছু ঘোষণা করা এক, আর তা কাজে করে দেখানো আর এক--- মন্ত্রীর ঘোষণার জেরে দমকলকর্মীদের মধ্যেই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। দমকলমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, এ বার বিভিন্ন এলাকায় থানায়-থানায় পুলিশকেই বাজারগুলোর নৈশ-নিরাপত্তার খুঁটিনাটিতে নজর রাখতে বলা হবে। বাজার বা অফিসের নিজস্ব কমিটিকেও সচেতন হতে হবে। এই সচেতনতা জরিপ করতে দমকল কর্তৃপক্ষ এখন সিসিটিভি-র ফুটেজে বিশেষ ভরসা রাখছেন। মন্ত্রীর নির্দেশ, সব বাজারে বা অফিসে বিভিন্ন তলায় ৭-৮টি করে ক্যামেরা বসিয়ে সিসিটিভি চালু রাখতে হবে। যাঁরা রাতে থাকছেন, তাদের গতিবিধি সিসিটিভি-র ফুটেজেই পাওয়া যাবে। চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালেও বিভিন্ন তলায় সিসিটিভি বসানোর নির্দেশ দিয়েছে দমকল। সেই সঙ্গে অগ্নিনির্বাপণ বিশারদ নিরাপত্তাকর্মীদের নিয়োগ, বিদ্যুতের লাইন মেরামতি ও অন্তত ২০টা করে আগুন নেভানোর যন্ত্র রাখার কথাও বলা হয়েছে।
দমকলের তরফে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল বহুতল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুরক্ষা সংক্রান্ত দরকারি পদক্ষেপ নিয়ে কথা হয়েছে। তাঁদের সম্মতির ভিত্তিতে বেসমেন্ট থেকে ১৪তলা অবধি কাজকর্ম অবিলম্বে শুরু করা যেতে পারে। আরও উপরে লিফ্ট চালুর বিষয়টির জন্য মুখ্য বিদ্যুত্ পরিদর্শকের ছাড়পত্র জরুরি। তবে ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে না-পেলে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ১৫, ১৬ ও ১৭তলায় অফিস চালুর ছাড়পত্র দেওয়া যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy