Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

দুর্গাদি নেই, ছবি টাঙিয়েই চলছে দোকান

ভুল ভাঙল কয়েক মিনিটেই। ওই ফুটপাত লাগোয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাদা সিডানের কাচ নামিয়ে এক ব্যক্তি মুখ বাড়িয়ে জানতে চাইলেন, ‘‘দুর্গাদি কোথায়?’’ ফুটপাতের এক ফুচকার দোকান থেকে এক যুবক বললেন, ‘‘মা তো মারা গিয়েছে। ব্যানার দেখুন!’’

স্মরণ: ফুচকার দোকানে দুর্গাদির ছবি-সহ ব্যানার। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

স্মরণ: ফুচকার দোকানে দুর্গাদির ছবি-সহ ব্যানার। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০২:২৫
Share: Save:

লোহার রড দিয়ে অস্থায়ী ছাউনি তৈরি হয়েছে ফুটপাতে। প্রতি রডের গায়ে তাঁর বিশাল ছবি-সহ ব্যানার! নীচে লেখা, কবে, কোথায় এবং কী ভাবে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। এক ঝলক দেখলে মনে হয় যেন কোনও জনপ্রতিনিধির প্রচার-ব্যানার! অনেকেই দাঁড়িয়ে দেখে বুঝতে না পেরে গন্তব্যের উদ্দেশে পা বাড়াচ্ছেন।

ভুল ভাঙল কয়েক মিনিটেই। ওই ফুটপাত লাগোয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাদা সিডানের কাচ নামিয়ে এক ব্যক্তি মুখ বাড়িয়ে জানতে চাইলেন, ‘‘দুর্গাদি কোথায়?’’ ফুটপাতের এক ফুচকার দোকান থেকে এক যুবক বললেন, ‘‘মা তো মারা গিয়েছে। ব্যানার দেখুন!’’

দুর্গা পণ্ডিত। পঞ্চাশ পেরোনো ওই মহিলার মাঝেমধ্যেই খোঁজ পড়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বিবেকানন্দ পার্ক লাগোয়া ফুটপাতে। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই ফুটপাতেই ফুচকার ব্যবসা চালিয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রাস্তা পেরোনোর সময়ে গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয় তাঁর। তত দিনে তাঁর ফুচকার নাম এতই হয়েছে যে, দোকান লাগোয়া ফুটপাতে মৃত্যুর খবর জানিয়ে ব্যানার টাঙাতে হয়েছে দুর্গাদেবীর পরিবারকে। তাঁর পুত্র পিকু সাউ বলেন, ‘‘নানা জায়গা থেকে প্রায়ই নতুন লোক এসে জানতে চান, মা কোথায়? উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাই। মাস ছয়েক আগে মায়ের ছবি দিয়ে ওই ব্যানারটা লাগিয়ে দিয়েছি।’’ খানিক থেমে তিনি বলেন, ‘‘মায়ের জন্যই আমাদের দোকানের এত পরিচিতি। ব্যানারটা দেখলে লোকেও বোঝেন যে, এটা মায়েরই দোকান।’’

১৯৭৩-এ ছয় বোন এবং এক ভাইকে নিয়ে বাবার সঙ্গে বিহারের ভাগলপুর থেকে কলকাতায় চলে আসেন দুর্গা। চারুমার্কেট এলাকায় ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। মা ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলেন। অন্য কোনও কাজ নয়, বাবা ঠাকুর পণ্ডিত শুধু ফুচকা বানাতে জানতেন। সেই থেকেই বিবেকানন্দ পার্কে ফুচকার দোকান পণ্ডিত পরিবারের। পিকু বলতে থাকেন, মাসিদের তুলনায় তাঁর মায়েরই বেশি ঝোঁক ছিল ফুচকার প্রতি। ঠাকুর পণ্ডিতের সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকেই ফুচকার কারবার শুরু দুর্গার। ‘‘দাদু মারা যাওয়ার পরে মা-ই ব্যবসা ধরে নেন। মায়ের সময়েই আমাদের দোকানের রমরমা। মুম্বইয়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তো বটেই, আমাদের ফুচকার বরাত আসত বিদেশ থেকেও,’’ বলেন পিকু। দুর্গার স্বামী শঙ্কর সাউ হাত লাগান স্ত্রীয়ের কাজে। নিজে আর অন্য কোনও কাজ শুরু করেননি।

তাঁদের ফুচকার বিশেষত্ত্ব কী? পিকুর দাবি, বরাত পেলে অন্তত ১৭ রকমের ফুচকা তৈরি করতে পারেন তাঁরা। সবচেয়ে বিখ্যাত কলা, পনির এবং মাংসের ফুচকা। এ ছাড়াও আলুরদমের ফুচকা, দই ফুচকা, ছোলা- মটরের ফুচকা বানান পিকুরা। সঙ্গে থাকে লেবু, পুদিনা, টক এবং জিরের জল। এত কিছু হয় কখন? পিকু বলেন, ‘‘মা থাকতে সকাল থেকে বাড়িতে নানা রকমের ফুচকা হত। এখন দুপুরে বাবা করেন। বিকেলে দোকান খুলি আমরা।’’

তবে দুর্গা পণ্ডিতের দোকানের ফুচকার বিক্রি এখন আগের চেয়ে কম। পিকু জানান, আগে দিনে চার হাজার টাকার বিক্রি হত। মা মারা যাওয়ার পরে অনেকেই আর আসেন না। তবু মায়ের ব্যবসা ধরে রাখতে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পিকু। সারাদিন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করে বিকেলে ফুচকা বিক্রি করেন তিনি। বললেন, ‘‘পরিবারের ব্যবসা, তাই ছাড়তে পারি না। মায়ের কাজ তো!’’

অন্য বিষয়গুলি:

Banner Death Stall
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE