Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

অনেক দিনের অবহেলাতেই মাঝেরহাটে এই বিপর্যয়!

সেতুটি কী ভাবে ভেঙেছে, তা এ দিন সরেজমিনে দেখতে যান কলকাতা পুরসভার নগর পরিকল্পনা দফতরের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল ও বর্তমানে শিবপুর আইআইইএসটি-র ‘আরবান ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ বিষয়ের শিক্ষক দীপঙ্কর সিংহ। তাঁর বিশ্লেষণ, মিড-স্প্যান কোল্যাপ্সের ফলে ব্রিজের বেলি-ল্যান্ডিং হয়েছে। অর্থাৎ, মাঝের অংশ ভেঙে তার পেটের কাছটা আগে মাটিতে পৌঁছেছে। তাই গাড়িগুলি ব্রিজের মাঝখানে এসে জড়ো হয়েছে।

পরিদর্শন: ঘটনাস্থল ঘুরে দেখছেন বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর সিংহ। —নিজস্ব চিত্র।

পরিদর্শন: ঘটনাস্থল ঘুরে দেখছেন বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর সিংহ। —নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:০৭
Share: Save:

‘মিড-স্প্যান কোল্যাপ্স’! মঙ্গলবার মাঝেরহাট সেতুর মধ্যভাগ ভেঙেই দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সে জন্য সেতুকে দোষ দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞদের একাংশ। বুধবার দুর্ঘটনাগ্রস্ত মাঝেরহাট সেতু ঘুরে দেখার পরে তাঁদের অভিমত, দীর্ঘদিন ঠিকমতো পরিচর্যার অভাবে ‘ফ্যাটিগ’ বা ‘ক্লান্তি’ জমা হয়েছিল ওই সেতুর মধ্যভাগে। আর ভার বহনের ক্ষমতা তার ছিল না। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে ভেঙে পড়ার আগের মুহূর্তে যদি দল বেঁধে কিছু মানুষ হেঁটে যেতেন সেতুর উপর দিয়ে, তা হলেও সেটি ভেঙে পড়ত।

সেতুটি কী ভাবে ভেঙেছে, তা এ দিন সরেজমিনে দেখতে যান কলকাতা পুরসভার নগর পরিকল্পনা দফতরের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল ও বর্তমানে শিবপুর আইআইইএসটি-র ‘আরবান ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ বিষয়ের শিক্ষক দীপঙ্কর সিংহ। তাঁর বিশ্লেষণ, মিড-স্প্যান কোল্যাপ্সের ফলে ব্রিজের বেলি-ল্যান্ডিং হয়েছে। অর্থাৎ, মাঝের অংশ ভেঙে তার পেটের কাছটা আগে মাটিতে পৌঁছেছে। তাই গাড়িগুলি ব্রিজের মাঝখানে এসে জড়ো হয়েছে।

এই ঘটনা আচমকা ঘটেনি বলেই দীপঙ্করবাবুর মত। পোস্তা উড়ালপুলের একাংশ যে ভাবে ভেঙেছিল, তাতে একটা আকস্মিকতা ছিল। সেটা যেন ছিঁড়ে পড়েছিল হঠাৎই। কিন্তু মাঝেরহাট ব্রিজের ক্ষেত্রে ‘‘বহু বছর ধরে মাঝের অংশটুকুতে ক্লান্তি জমা হয়েছে। যে কারণে ওই অংশের সিমেন্ট ও লোহার স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভার বহনের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রমের ফলে সেটা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু এটা হঠাৎ হয়নি। এই মধ্যভাগ আস্তে-আস্তে নীচে নামছিল। ফলে এই বিপর্যয় এড়ানোর সময় ছিল।’’ বলছেন দীপঙ্করবাবু।

বিপজ্জনক: মাঝেরহাট স্টেশনের কাছে সেতুর ধসে পড়া অংশের পাশে লোহার খাঁচার ঠেকনা। —নিজস্ব চিত্র।

কলকাতা পুলিশের ফরেন্সিক বিভাগের অধিকর্তা ওয়াসিম রাজার নেতৃত্বে একটি দলও এ দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তারাও প্রাথমিক ভাবে মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পূর্ত দফতর সূত্র জানাচ্ছে, সেতুটির শেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছিল ছ’মাস আগে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ছ’মাসের ক্লান্তিতে সেতু ভেঙে পড়া অসম্ভব। বরং, সেই পরীক্ষাতেই তার বেহাল অবস্থা ধরা পড়ার কথা।

দীপঙ্করবাবু জানান, সব সেতুর ক্ষেত্রেই উপরিভাগের অংশের (যেখান থেকে গাড়ি চলাচল করে) সঙ্গে গার্ডারগুলির (আকারে বড় বিম) মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ‘স্পেস’ বা ফাঁক থাকে। যান চলাচলের সময় ওজনের কারণে সেই ফাঁক বাড়ে-কমে, পরিভাষায় যাকে ‘ডিফ্লেকশন’ বলে। এই ‘ডিফ্লেকশন’-এর নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে। ‘ডিফ্লেকশন’ বেশি হচ্ছে কি না এবং তার ফলে সেতুটি আস্তে-আস্তে নীচে নেমে যাচ্ছে কি না, তা ‘হেলথ-অডিটে’ ধরা পড়া উচিত।

আরও পড়ুন: রেলকে খোঁচা মমতার, পাল্টা যুক্তি রেলেরও

আরও পড়ুন: এক বছর অবহেলায় আটকে মাঝেরহাটের ৩ কোটির সংস্কার

জানা গিয়েছে, গত বছরই মাঝেরহাট সেতু সংস্কারের পরিকল্পনা করেছিল রাজ্য সরকার। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, তার অর্থ তো সেতুর দূরবস্থা সম্পর্কে সরকার ওয়াকিবহাল ছিল! এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘এক সময় যদি কোনও সেতুর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে যায় বা তার কাঠামোয় বিচ্যুতি আসে, তা হলে কোনও সংস্কার ছাড়াই সেটি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে, এটা ভাবার তো কোনও কারণ নেই!’’

পুলিশের একাংশের বক্তব্য, সেতুর নীচে একটি ছোট খাল রয়েছে। তার জল থেকে সেতুর গার্ডারের ক্ষতি বা বিচ্যুতি হয়েছিল কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি সেতুর উপরে প্রায় ৭ ইঞ্চি পুরু বিটুমিন রয়েছে। সন্দেহ, দিনের পর দিন তাপ্পি মারার ফলে এটা হয়েছে। এতে সেতুর উপরে অতিরিক্ত ভার পড়েছিল বলে মনে করছেন তদন্তকারীদের একাংশ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE