চার বার সিরিঞ্জ ভাঙার পরে পঞ্চম বার ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জটি ব্যবহার করতে পেরেছিলেন এসএসকেএমের নার্স। গ্লাভস পরতে গিয়ে পাঁচ বার ছিঁড়ে যাওয়ার পরে ষষ্ঠ গ্লাভসটি পরার উপযুক্ত হয়েছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারের। ক্ষতস্থানে সেলাই করতে গিয়ে সুতো ছিঁড়ে যাওয়ায় হতবাক হয়েছিলেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ মিনিটে রক্তচাপ মাপার তিনটি যন্ত্রে ফল এসেছিল তিন রকম। একটির সঙ্গে আর একটির ফারাক বিস্তর। নতুন কেনা পাল্স অক্সিমিটার কাজ করেনি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। একটি নয়,
তিনটি যন্ত্রের ক্ষেত্রে একই রকম অবস্থা দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন ওয়ার্ডের ডাক্তারেরা।
সরকারি হাসপাতালে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকেই নিখরচায় চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ফ্রি-এর গেরোয় পড়ে দৈনন্দিন ব্যবহারের বিভিন্ন জিনিসের মান তলানিতে ঠেকেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, সব ফ্রি হওয়ায় সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার খরচ এক ধাক্কায় কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে হুহু করে। এই পরিস্থিতিতে সকলকে পরিষেবা দিতে গিয়ে সরঞ্জামের মানের সঙ্গে আপস করা হচ্ছে বহু ক্ষেত্রেই। অচিরেই এ ব্যাপারে বিকল্প ব্যবস্থা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
স্বাস্থ্য ভবনে সম্প্রতি রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামের মান নিয়ে এমনই একগুচ্ছ অভিযোগ জমা পড়ে। যা দেখে মাথায় হাত স্বাস্থ্যকর্তাদের। দিন কয়েক আগে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং সুপারদের নিয়ে একটি বৈঠক ডেকেছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারা। সেখানেও দফতরের শীর্ষ কর্তাদের সামনে বিভিন্ন হাসপাতালের সুপারদের তরফে এমন ভূরি ভূরি অভিযোগ সামনে আসে। একাধিক হাসপাতালের সুপার জানান, এ ভাবে তাঁদের পক্ষে পরিষেবা দেওয়া সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। ইতিমধ্যেই কয়েকটি সংস্থাকে এ ব্যাপারে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে আরও কয়েকটি সংস্থাকে। স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, কোনও ভাবেই মানের সঙ্গে আপস করা হবে না। স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ সচিব সুবীর চট্টোপাধ্যায় এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, তাঁরা চান, যে কোনও রকম অসুবিধা হলেই ডাক্তারেরা লিখিত ভাবে অভিযোগ করুন। কারণ অভিযোগ না এলে তাঁরাও বহু ক্ষেত্রে প্রকৃত পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও সংস্থার জন্য সরকারের উদ্যোগ নষ্ট হবে, তা মানা হবে না। যে ভাবে হোক, মানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’’
আরও পড়ুন:ভাবমূর্তি ফেরানোর তৎপরতা অ্যাপোলোয়
সরকারি হাসপাতালে ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জামের মান নিয়ে এমন অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও একাধিক বার সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ হওয়া ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সরকারি ডাক্তারেরাই। অ্যান্টিবায়োটিক, এমনকী, সরকারি হাসপাতালে দেওয়া প্যারাসিটামল খেলেও কাজ হয় না বলে অভিযোগ উঠেছে। বহু ডাক্তার এমনও বলেছেন যে, সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় দেওয়া ওষুধে কাজ হয় না বলেই তাঁরা বাধ্য হয়ে রোগীদের বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে বলেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ওষুধ সরবরাহকারী সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্তও করা হয়েছে।
কেন মান নিয়ে এমন সমস্যা? স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশ মানছেন, সব চেয়ে কম দর দেওয়া সংস্থাকে বরাত দেওয়ার ব্যবস্থাই এ ক্ষেত্রে দায়ী। সরকারি বরাত পাওয়ার জন্য বহু সংস্থাই দাম অনেকটাই কমিয়ে বলে। বরাত পাওয়ার পরে মানের সঙ্গে আপস করে জিনিস সরবরাহ করে তারা। যার ফল ভুগতে হয় সাধারণ রোগীদের।
সরকারি চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশই জানিয়েছেন, গত কয়েক মাসে চিকিৎসা সরঞ্জামের মান কার্যত তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আগেও খারাপ ওষুধ বা সরঞ্জামের সমস্যায় কখনও কখনও জেরবার হয়েছেন তাঁরা। কিন্তু ইদানীং বিষয়টি প্রাত্যহিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘অন্য জিনিসের মান খারাপ হওয়া আর ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জামের মান খারাপ হওয়া— এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রোগীর জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত। আরও সতর্ক না হলে বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy