ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ হলেন নারী। কিন্তু ভোটের ইস্তেহার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদের দৈনন্দিন প্রতিশ্রুতি, সেখানে কতটা ঠাঁই পায় তাঁদের কথা? ১৭তম লোকসভা নির্বাচনের সময়ে মেয়েদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবির কথা এখানে তুলে ধরছি। দেশজুড়ে এখন মেরুকরণ এবং বিভাজনের রাজনীতির শিকার হচ্ছেন সব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষ। মুসলমান সম্প্রদায়, দলিত, আদিবাসীদের মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে একটি দল নারীও। আমাদের দাবি, নারীদের পাশাপাশি, সব ধরনের সংখ্যালঘুর উপরেই নির্যাতন অবিলম্বে বন্ধ করা হোক। আমরা ভারতবর্ষকে সংবিধান স্বীকৃত, ধর্ম নিরপেক্ষ এবং অন্তর্ভুক্তিকরণের নীতিতে বিশ্বাসী একটি দেশ হিসেবে দেখতে চাই। এমন একটা জায়গা, যেখানে কোনও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ভয় ছাড়া মানুষ ভিন্ন মত পোষণ করতে পারবে। সুপ্রিম কোর্ট, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, সেন্ট্রাল বুরো অব ইনভেস্টিগেশনের মতো দেশের গণতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষাকারী সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানগুলি যেন স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে, সেটাও দেখা দরকার।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতবর্ষের নারী-পুরুষের অনুপাত হল প্রতি ১০০০ জন পুরুষ পিছু ৯৪৩ জন নারী। কিন্তু ভারতীয় নারীদের স্বাক্ষরতার হার মাত্র ৬৫.৪৬ শতাংশ। আমাদের দাবি, মেয়েদের জন্য নিরাপদ রাস্তাঘাট ও যানবাহন, স্কুলে শৌচালয়ের সুবিধা থাকুক। তাঁদের উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারি তহবিল গড়ে তোলা হোক। যাতে সর্বস্তরের মেয়েরা এগিয়ে যেতে পারেন। চতুর্থ ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ অনুযায়ী দেখা গিয়েছে যে, এ দেশে ৩১ শতাংশ বিবাহিতা নারী বাড়িতে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’র ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৮,৯৮২ জন নারী তাঁদের স্বামী অথবা শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের হাতে খুন হয়েছেন এবং ১,২৩,১৮৭ জন কোনও না কোনও ভাবে যৌন নির্যাতন এবং যৌন উৎপীড়নের শিকার হয়েছেন। আমাদের দেশে নারীর অধিকার রক্ষা সংক্রান্ত আইন রয়েছে। তবু নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। এই সব আইনের মধ্যে মেয়েদের জন্য যে সব পরিষেবার কথা বলা আছে, তা বাস্তবায়িত
করার জন্য সরকারি স্তরে যথেষ্ট বাজেটের ব্যবস্থা করা হোক। সরকারি নীতি যেন শুধু মুখের কথা হয়ে থেকে না যায়।
২০১৮ সালের বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতবর্ষে নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের (লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন) হার ২৬.৯৭ শতাংশ। যেখানে পৃথিবীর গড় হার হল ৪৮.৪৭ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বহু মহিলাকে এখনও ঘরের কাজ সামলানোর জন্য, শিশু ও বয়স্কদের দেখভালের জন্য কিংবা কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের আশঙ্কায় চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। এ দিকে, বাড়িতে মেয়েদের কাজের না আছে কোনও স্বীকৃতি, না কোনও পারিশ্রমিক। ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বলা যায়, বাড়ির কাজ আর্থিক মূল্যে মাপা গেলে আমাদের দেশের জিডিপি-কে ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি করবে। আমরা চাই মেয়েদের ঘরের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। সর্বস্তরের নারীদের জন্য শহর ও গ্রামে আরও ভাল এবং আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ, ন্যায্য মজুরি এবং যৌন নির্যাতনমুক্ত নিরাপদ কর্মস্থলও চাই আমরা। সমান কাজের জন্য নারীদের সমান মজুরি দেওয়াও এই দাবির মধ্যে পড়ে।
বর্তমানে ভারতবর্ষের মোট জিডিপি-র মাত্র ১.০২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে জনস্বাস্থ্যের খাতে। এর ফলে স্বাস্থ্য পরিষেবা অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ হয়ে গিয়েছে। সব পরিবারের উপরেই এর কারণে আর্থিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবায় খরচের ক্ষেত্রে পরিবারের মেয়েরা কখনওই অগ্রাধিকার পান না। অভাব অনটনের সময়ে এই বিভেদ আরও প্রকট হয়ে ওঠে। আমরা দাবি করছি, স্বাস্থ্য পরিষেবা একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে জনসাধারণের জন্য বিনামূল্যে সহজলভ্য করা হোক। ২০১৯-র ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিতে যাওয়ার সময়ে এই জরুরি বিষয়গুলি যেন আমাদের মাথায় থাকে।
আরও একটি প্রশ্ন। লোকসভা এবং রাজ্যসভায় মেয়েদের প্রতিনিধিত্বের হার খুবই কম। ১৬তম লোকসভায় মাত্র ১২ শতাংশ এবং রাজ্যসভায় আরও কম। মহিলাদের জন্য লোকসভা এবং রাজ্যসভায় ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের বিল পাশের জন্য আরও কত দিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy