Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

সোনাগাছির আঁধারে জীবনের আলো ছড়াচ্ছে ‘কোমলগান্ধার’

সোনাগাছির সার দেওয়া ঘরগুলোতে তখন উঁকি দিচ্ছে পড়ন্ত বেলার রোদ। চোখে ঠোঁটে রং ঘষে একটু একটু করে এ বার তৈরি হওয়ার পালা। সন্ধ্যে হতে না হতেই যে ভিড় জমাবেন ‘বাবু’রা। জংধরা বারান্দায় হেলান দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গুনগুন করছিলেন সুলেখা রায়।

মহড়ায় ‘কোমলগান্ধার’। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

মহড়ায় ‘কোমলগান্ধার’। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

মধুরিমা দত্ত ও সৌভিক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৫ ২১:৩৪
Share: Save:

সোনাগাছির সার দেওয়া ঘরগুলোতে তখন উঁকি দিচ্ছে পড়ন্ত বেলার রোদ। চোখে ঠোঁটে রং ঘষে একটু একটু করে এ বার তৈরি হওয়ার পালা। সন্ধ্যে হতে না হতেই যে ভিড় জমাবেন ‘বাবু’রা। জংধরা বারান্দায় হেলান দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গুনগুন করছিলেন সুলেখা রায়। পাশের জানলায় চোখে কাজল দিতে দিতে সেই গান শুনছিলেন অতসী পাল। গান শেষ হওয়ার পরই অতসী বললেন, ‘‘বাহ! তোর গলাটা তো বেশ ভাল।’’ লজ্জা পেয়ে হাসলেন সুলেখা। কিন্তু মনে মনে সেই ‘বেশ ভাল’টা যেন বলে দিচ্ছিল এখানেই শেষ নয়।

নিত্য দিনের যন্ত্রণার বিনিময়ে একটুকরো আকাশ খুঁজতে চাইছিলেন তাঁরা। তাই সেই গুনগুনিয়ে ওঠা সুরটাকে সম্বল করেই তৈরি করে ফেলেছিলেন ‘কোমলগান্ধার’। কিন্তু সেই কোমলগান্ধার যে এক দিন তাঁদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে, গান, নাচ, নাটকের মহড়ায় পাল্টে দেবে সোনাগাছির বিকেলগুলো, তা অবশ্য যৌনকর্মীরা বুঝতে পারেননি সে দিন।

কী এই কোমলগান্ধার?

কোমলগান্ধার-এর সদস্য সুলেখা রায় জানান, মাত্র কয়েক জন যৌনকর্মীর উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে অনুমোদিত সংগঠন রূপে আত্মপ্রকাশ করে কোমলগান্ধার। তার বছর দুয়েকের মধ্যেই আসে এক বিরাট সুযোগ। জেনিভাতে বিশ্ব এডস দিবসের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ডাক পায় কোমলগান্ধার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই দর্শকের মন জয় করে নেয় তারা। অনেকটাই বেড়ে যায় মনোবল। তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বাস করুন, সেই প্রথম বার, মনে হয়েছিল আমরাও পারি। আমরাও ফেলনা নই।’’ এর পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও কখনও ব্যাংকক থেকে সিঙ্গাপুর, কখনও আবার দিল্লি থেকে তামিলনাড়ু কোমলগান্ধারের সুর ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্রই।

কিন্তু কেমন ছিল শুরুর দিনগুলো?

কোমলগান্ধারের সদস্য তাঞ্জিনা খাতুন জানান, সহজ ছিল না লড়াইটা। প্রথম প্রথম শুধু যৌনকর্মীরা এলেও ক্রমশ মায়েদের হাত ধরে আসতে শুরু করল তাঁদের সন্তানেরাও। কিন্তু তালিম নিতে গিয়ে বারেবারেই অপমানের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে কেউ শেখাতে চায়নি আমাদের। বলেছে, ‘তোমরা এলে কোনও ভদ্রঘরের বাচ্চা আর শিখতে আসবে না। তোমাদের শেখাতে গিয়ে আমাদের ব্যবসা লাটে তুলব নাকি?’ অনেকে তো ঘাড়ধাক্কাও দিয়েছে।’’

কোমলগান্ধারে মূকাভিনয়ের তালিম দেন শিল্পী রণেন চক্রবর্তী। তিনি জানান, প্রথম দিকে অনেকের মধ্যেই এঁদের নিয়ে মজা করার প্রবণতা ছিল। কিন্তু ১৯৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত নাট্যমেলায় ‘ভালো মানুষ নই গো মোরা’ নামের একটা নাটক করে কোমলগান্ধার। সেই সময় নিয়মিত মহড়ায় উপস্থিত থাকতেন বিশিষ্ট নাট্যশিল্পীরা। এই নাটকটার পরই সবাই চমকে যায়। রণেনবাবু বলেন, ‘‘আসলে সবাই যেটাকে এদের দুর্বলতা ভাবে আসলে সেটাই এদের শক্তি।’’

বাইরে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে সমস্যা হয়নি কখনও?

অবশ্যই হয়েছে। জানান কোমলগান্ধারের রূপান্তরকামী সদস্য ববি পাল। অনেক সময়েই লোকে মদ খেয়ে এসে অসভ্যতা করে। আমাদের দিকে নোংরা ভাবে তাকায়। বলে ‘হিজড়া নাচ’ দেখাতে। তিনি বলেন, ‘‘আগে খুব কষ্ট হত। মাঝে মাঝে মনেও হয়েছে, কী হবে এই সব করে? সমাজের চোখে আমরা চিরকাল একঘরেই থাকবো।’’ কিন্তু শত মন খারাপ সত্ত্বেও লড়াইটা জারি রেখেছিলেন কোমলগান্ধারের সৈনিকরা। রোজ একটু একটু করে নিজেদের তৈরি করেছেন। তালিম নিতে শুরু করেছেন বিভিন্ন শিল্পীর কাছে।

তবে এখন অবশ্য অনেকটাই পাল্টেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এমনটাই দাবি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আন্দোলনের অন্যতম অস্ত্র এখন কোমলগান্ধার। শুধু তাই নয়, আগামীতে জীবিকার দিশাও দেখাবে এই দলটি।’’ একই মত ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মুখ্য উপদেষ্টা স্মরজিৎ জানারও। তিনি জানান, পারফর্মিং আর্টস বা নানা শিল্পমাধ্যমে মানুষের ভিতরের কথাগুলো বেরিয়ে আসে সহজে। সমাজের কাছে নিজেদের তুলে ধরতে সুবিধা হয়। তিনি বলেন, ‘‘সমস্ত যৌনপল্লীরই একটা নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে। এখানে ওরা সেটাকে কাজে লাগিয়েছে।’’

আর তাতেই আসছে একের পর অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ। ‘ডেট’ দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন কোমলগান্ধারের শিল্পীরা। খুব শিগগিরই ঢাকা পাড়ি দেওয়ার কথা জানালেন কোমলগান্ধারের সম্পাদিকা প্রিয়া ঘোষ। তা ছাড়া এই দুর্গাপুজোতেই তাঁদের বায়না রয়েছে শহরের নানা পুজোকমিটির অনুষ্ঠানে। দুর্গাপুরেও পুজোর অনুষ্ঠানে যেতে হবে তাঁদের।

কমবয়সে বিয়ে করে ফেলেছিল মণীষা। স্বামীর ঘরে জুটেছে রোজকার মারধর। তবু নাচ ছেড়ে থাকতে পারেনি সে। তিন বছরের সন্তানকে নিয়ে নিয়মিত মহড়ায় আসে মণীষা। ছোট থেকেই গান গাইত মিতা। বদলে বাবার থেকে জুটত মার। আর এখন? নিয়মিত রাগসঙ্গীতের তালিম নিচ্ছে সে। যৌনকর্মীর সন্তান হয়ে প্রেম করার খেসারত দিতে হয়েছে প্রিয়াকে। প্রেমিকের বাড়ির লোক চড়াও হয়েছে তার উপর। তবু প্রিয়ার দৃপ্ত উচ্চারণ, ‘‘বিয়ে যদি করি, কাগজে লেখা থাকবে কোমলগান্ধার ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাতে ছেলের সই থাকবে। তবেই বিয়ে।’’

এ ভাবেই বহু যৌনকর্মীকে বেঁচে থাকার নতুন আশা দিয়ে সোনাগাছির বড় আদরের ধন এখন কোমলগান্ধার!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE