জীবে প্রেম: গরুকে রুটি খাওয়াচ্ছেন এক ব্যক্তি। বুধবার সকালে, সল্টলেকে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
ঠিক যেন পালাগানের আসর। তবে গাওয়া হচ্ছে গরু ও গরুর মহিমা নিয়ে লেখা গান।
কলকাতায় তৈরি হওয়া একাধিক গো-সেবা সংগঠনের তরফে আয়োজন করা হচ্ছে এই গো-কীর্তনের আসরের। অনেক অবাঙালি পরিবারে খাবারের একাংশ গরুকে দেওয়ার চল ছিল বলে জানাচ্ছেন এমনই এক সংগঠনের প্রধান হরিকৃষ্ণ শরাফ। কিন্তু শহরে গরুর অভাব ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের জেরে প্রথাটি প্রায় উঠে যাচ্ছিল। সেই প্রথা ফিরিয়ে আনতে উত্তর ও পূর্ব কলকাতার কিছু আবাসনে রাখা হয়েছে গরুর ছবি আঁকা বাক্স। আগ্রহীরা রোজ সেখানে রুটি এবং আনাজের খোসা ফেলছেন। স্বেচ্ছাসেবকেরা সেগুলি দিয়ে আসছেন বিভিন্ন গোশালায়। ২০১৭ সালের রথযাত্রা থেকে এ ভাবেই প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার কেজি খাবার তাঁরা আনন্দপুরের একটি গোশালায় দান করেছেন বলে দাবি হরিকৃষ্ণের। এই কাজকে তাঁরা ব্যাখ্যা করছেন ঐতিহ্য ও পরম্পরা ছুঁয়ে থাকার চেষ্টা হিসেবে।
ফুলবাগান, কাঁকুড়গাছি, লেক টাউন, বাঙুর, শ্রীভূমি এলাকায় তাঁদের সদস্যেরা রয়েছেন জানিয়ে হরিকৃষ্ণ বলেন, ‘‘ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে গরু মিলেমিশে আছে। গরুকে আমরা পুজো করি। কিন্তু গোমাতার অনেক কষ্ট। নতুন প্রজন্মকে সচেতন
করতে চাইছি।’’ ২০১৫ সালে প্রথম ‘গরুর সঙ্গে সেলফি’ প্রতিযোগিতা তরুণদের মধ্যে খুব সাড়া ফেলেছিল বলে দাবি তাঁর।
সম্প্রতি এমন সংস্থার হাত ধরে শহরের কিছু উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের ছোট-ছোট গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এঁরা বেশির ভাগই বাঙালি। কেউ অধ্যাপক বা শিক্ষক, ব্যবসায়ী বা উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী। তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত ধ্যানচর্চা, বৈদিক সংস্কৃতি, মন্ত্রের অর্থ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এঁদের কেউ কেউ পথশিশুদের স্কুল চালান। সেখানে পড়াশোনার সঙ্গে যজ্ঞের পদ্ধতি ও উপকারিতা, ঠিক মন্ত্রোচ্চারণ, যোগও শেখানো হয়। প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় শহরে আয়োজন করা হয় বৈদিক যজ্ঞের। মন্দিরের বাইরে খাবার বিলি, গোশালার দেখভাল, মালিকানাহীন ও অসুস্থ গরুদের গোশালায় রাখা, গরুগুলিকে ‘দত্তক’ নিয়ে খাবার ও ওষুধের ব্যবস্থা করাও রয়েছে সংস্থাগুলির কর্মসূচিতে। বাড়ির শিশুদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই গোশালায়।
গত কয়েক বছরে বেদ-পুরাণচর্চা, মন্ত্র, যজ্ঞ এবং গরুভক্তির উদ্যাপনকে কলকাতার নাগরিকদের একাংশ দেশজ সংস্কৃতি, বিশ্বাসের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তবে আগে এই প্রবণতার এত উচ্চকিত বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়নি বলে স্বীকার করছেন সুশীল সমাজের অনেকেই। তাঁদের আশঙ্কা, সময়ের সঙ্গে সংস্কৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তন রুখে দিয়ে ঐতিহ্য বজায় রাখার আপাত সাংস্কৃতিক চেষ্টার আড়ালে বিশেষ একটি রাজনৈতিক ধারণা শহুরে মানসিকতায় গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
অনেকেরই মনে পড়ছে সুকুমার রায়ের ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ নাটকের আশ্রমের কথা। সেখানে ছাত্রদের মগজে ঢোকানো হত যে, সহজ বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে যে কোনও শব্দ বা বস্তুকে অবলম্বন করে তা থেকে পর্যায়ক্রমে নানা অনুভূতির ধারাকে ফুটিয়ে তোলা যায়। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আশ্রমের প্রধান শ্রীখণ্ড বলেছিলেন, ‘‘গোরু—গো মানে স্বর্গপশুবাকবজ্র—দিঙনেত্রঘৃনিভূজলে, গো মানে গোরু, গো মানে দিক, গো মানে ভূ—পৃথিবী, গো মানে স্বর্গ, গো মানে কত কী। সুতরাং এটা সাধন করলে গো বললেই মনে হবে পৃথিবী, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, ব্রহ্মাণ্ড।’’ ছাত্ররা আশ্রমে গাইতেন গরুর সূত্র, ‘‘মৃত্যু ভয়াবহ হম্বা হম্বা, হম্বা/রৌরব তরণী তুহুঁ জগদম্বা...!’’
মগজ ধোলাইয়ের সেই ‘ট্র্যাডিশন’ অব্যাহত মেনে নিয়ে প্রবীণ সমাজতাত্ত্বিক আন্দ্রে বেতেই বলছেন, ‘‘পুরাকালে মানুষ যে ভাবে থাকত বা যা করত তাতে ফেরা আর সম্ভব নয়। সামাজিক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, হয়ে চলেছে। তাকে পিছনো যায় না বা উল্টে দেওয়া যায় না। তাই এটা স্পষ্ট যে এর মধ্যে বিজেপির একটা প্রভাব রয়েছে।’’ সমাজতাত্ত্বিক রুচিরা ঘোষের ব্যাখ্যাতেও, ‘‘সরস্বতী শিশু বিদ্যালয় বা দুর্গাবাহিনীর মতো সংগঠনের মাধ্যমে অনেক দিন থেকেই আরএসএস সুচারু ভাবে মূলত গ্রামবাংলায় তাদের রাজনৈতিক ভাবধারা অনুপ্রবেশ করানোর কাজ করছে। এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক আবহে আলোকপ্রাপ্ত শহুরে নাগরিকদের অন্দরমহল এবং মগজেও সনাতন ঐতিহ্যকে ছুঁয়ে থাকার অছিলায় হিন্দুত্ববাদকে ঢোকানোর চেষ্টা হচ্ছে।’’
এই ধরনের গোষ্ঠীগুলি অবশ্য রাজনৈতিক প্রভাবের কথা স্বীকার করতে নারাজ। দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, এক অধ্যাপিকার দাবি, ‘‘আমরা পুরোপুরি অরাজনৈতিক, ধর্মমুখী কাজের স্বেচ্ছাসেবক। ভারতের মহান সংস্কৃতির গোড়ায় ফিরতে চাইছি। ফিরিয়ে আনতে চাইছি আধ্যাত্মিক শিক্ষার বাতাবরণ।’’ রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘এ সব কর্মসূচির সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা কুসংস্কার ছড়াচ্ছেন কি না, বলতে পারব না। তবে বেআইনি না হলে আমরা এমন কর্মসূচির বিরোধিতাও করছি না।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy