পক্ষীরাজ: শহরের পথে সওয়ারি নিয়ে আনন্দযাত্রা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
ব্যবসার অবস্থা নাকি ভাল নয়?
প্রশ্নটা শুনেই সপাটে ছক্কা হাঁকালেন রতনকুমার দাস। ‘‘কে বলেছে? আমরা এতগুলো মানুষ এ ভাবেই তো চালাচ্ছি। ব্যবসা ২৫ বছর আগে যেমন ছিল তেমনই আছে। তখন তো ভাড়া ছিল ১০ টাকা, আর এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪০০ টাকা। খারাপটা কী হয়েছে?’’
রবিবাসরীয় বিকেলের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে তখন বেশ ভিড়। প্রধান ফটক থেকে কয়েক জন রাস্তা পেরিয়ে চলে আসছিলেন সার দিয়ে দাঁড়ানো ঘোড়ায় টানা গাড়িগুলোর দিকে। পড়ন্ত বিকেলের রোদ মেখে ছুটির আমেজটা দীর্ঘায়িত করতে চেপে বসছিলেন পছন্দের গাড়িতে। টগবগ শব্দে ময়দান, ফোর্ট উইলিয়ামের গেট ঘুরে ফের ভিক্টোরিয়ার সামনে এসে ‘জয় রাইড’-এর ইতি।
ইতিহাস বলছে, ১৭৯৮-৯৯ সালে তৈরি হয় শহরের প্রথম চওড়া রাস্তা— সার্কুলার রোড। লর্ড ওয়েলেসলি বাংলার গভর্নর জেনারেল থাকাকালীন ক্রমশ বাড়তে থাকল বাঁধানো রাস্তার সংখ্যা আর শহরের পরিধি। ১৮০৫-এর পরে তৈরি হয় স্ট্র্যান্ড রোড, ওয়েলিংটন স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিট, মির্জাপুর স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাস্তা। খোয়া বাঁধানো রাস্তা আর ঘোড়ার গাড়ির যুগলবন্দিতে বেড়ে গেল শহরটার গতি। পরিচয় হল ব্রাউনবেরি, ল্যান্ডো, ফিটন, ব্রুহাম, ছ্যাকরা, টমটম-এর মতো নানা কিসিমের গাড়ির সঙ্গে। তার পরে প্রায় এক শতাব্দী ঘোড়ার গাড়িই ছিল আভিজাত্যের প্রতীক, আবার শহরের একমাত্র গণ পরিবহণও। উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যেও হামেশাই মেলে ঘোড়ায় টানা গাড়ির উল্লেখ।
মোটরগাড়ি এসে যাওয়ার পরে বিশ শতকের গোড়ায় চলতে শুরু করে যাত্রীবাহী বাস ও ট্যাক্সি। স্বাধীনতার পরেও অবশ্য হাওড়া ও শিয়ালদহ এলাকায় চলেছে ঘোড়ার গাড়ি। রাস্তায় অন্য গাড়ির ভিড়, দূষণের মতো নানা কারণে চলার পরিসর কমতে কমতে বর্তমানে এই গাড়ি আটকা পড়েছে ময়দানের নির্দিষ্ট জায়গায়। সংখ্যাও কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫-এ। এখন মেনে চলতে হয় অনেক নিয়ম। বেলা এগারোটার আগে ঘোড়ার গাড়িগুলোর ভিক্টোরিয়ার সামনে হাজির হওয়ার অনুমতি নেই। এ ছাড়া, প্রতি বছর লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করাতে হয়।
লাল, রুপোলি, সোনালির মতো উজ্জ্বল রং, কাচ বা আয়নার টুকরো দিয়ে সাজানো খান কুড়ি বড় গাড়ির মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিল একটি মাত্র রংচটা ল্যান্ডো। আর কোনও ল্যান্ডো বা ফিটন নেই?
‘‘ও সব গাড়ি তো পুরনো হয়ে গিয়েছে। আর চলে না। ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে যেমন জিন্স-টি শার্টের চল হয়েছে, তেমনই ঝাঁ-চকচকে গাড়ি না হলে এখন কেউ উঠতে চান না। লোক টানার জন্যই গাড়িতে এলইডি আলো বা গান চালানোর ব্যবস্থা রাখতে হয়। গুজরাত থেকে আসে বলে এ সব গাড়ির নামই হয়ে গেছে গুজরাত গাড়ি।’’— বললেন রাজেশ মণ্ডল। তিন পুরুষের ব্যবসা রাজেশদের। ছাড়ার কথা ভাবেনও না।
ফের উঠল ব্যবসার কথা। বর্ষায় ব্যবসা ভালো চলে না, স্পষ্টই জানালেন রাজেশ। তবে শীতে পুষিয়ে যায়। অনেক বরাত আসে বিয়ের অনুষ্ঠানের। তার সঙ্গে ময়দান চত্বরে উপচে পড়া ভিড়ে জয় রাইডের সংখ্যাও বাড়ে। বছরের বাকি সময়টুকুতে ভরসা পুজো আর বিসর্জন। এই আয় থেকেই তাঁরা তিন-চার লক্ষ টাকা খরচ করে গাড়ি আনান। বিহারের শোনপুরের পশুমেলা থেকে কেনেন ঘোড়া। দাম ঘোরাফেরা করে ৪০ হাজার থেকে ৭০ হাজারের মধ্যে। এ ছাড়া রয়েছে ঘোড়ার দেখাশোনা করার খরচ। এক-একটি ঘোড়ার জন্য রোজ লাগে ৬০০-৭০০ টাকা। ‘‘ওরা আমাদের পরিবারেরই অঙ্গ। যদি কোনও দিন ৪০০ টাকা আয় হয়, তা হলে ২০০ টাকা ওদের জন্য রাখব, বাকিটা বাড়ি নিয়ে যাব।’’— বলছিলেন রতনকুমার।
পুরনো রেসের ঘোড়া কেনেন নাকি? ‘দেশি’ ঘোড়ার পরিশ্রম করার ক্ষমতার প্রশংসা করে প্রশ্নটা নস্যাৎ করে দিলেন আদিল। নিজের দু’টি ঘোড়ার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘‘রেসে ফ্যান্সি ঘোড়া দৌড়োয়, এত ভারী গাড়ি ওরা টানতেই পারবে না। দু’পা দৌড়েই বসে পড়বে।’’
চকচকে মুখে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটি গাড়ি থেকে নামছিলেন রোহিত। থাকেন আমেরিকায়। তাঁর মা সঙ্গীতা তিওয়ারি ময়দানে এলেই চড়তেন ফিটনে। সেই অভিজ্ঞতার শরিক করতে এ বার এনেছেন ছেলেকেও। কি়ঞ্চিৎ ঝাঁকুনি ছাড়া জয় রাইড বেশ উপভোগ্য হয়েছে, জানালেন রোহিত।
মহানগর কলকাতার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তবু দ্রুত বদলাতে থাকা শহরটায় নস্টালজিয়া মেখে দৌড়ে চলেছে ঘোড়ায় টানা গাড়ি। আদিলদের বিশ্বাস, আগামী বছরগুলিতেও জারি থাকবে এই দৌড়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy