ধৃত চাঁই আফতাব
ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রী, তিন ছেলে এবং এক কলেজপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে বিহারের ভাগলপুর থেকে সে চলে এসেছিল কলকাতায়। তার পরে বন্দর ঘেঁষা দক্ষিণ শহরতলির রবীন্দ্রনগরে বাড়ির সামনে একটি ছোট মুদিখানা খুলে বসে মহম্মদ আফতাব। আপাত দৃষ্টিতে আর পাঁচটি মামুলি মুদিখানার মতোই। কিন্তু তা ছিল আসল ব্যবসার আড়াল মাত্র। ওই ছোট্ট মুদিখানার পিছনেই চলত একটি অস্ত্র কারখানা। মঙ্গলবার রবীন্দ্রনগরের খানকুলিতে অস্ত্র কারখানার হদিস পাওয়ার পরে এমনটাই জেনেছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, আফতাবের দোকানে সাধারণ মুদির জিনিসের সঙ্গে বিক্রি হত বোমার মশলাও। সেখানে প্রায় ১০ কেজি বোমা তৈরির লাল-সাদা মশলা পেয়েছে পুলিশ।
আফতাবের অস্ত্র এক অর্থে মুঙ্গেরি-ই বলা চলে। এক তদন্তকারী অফিসার জানান, এলাকাটি দেখে মনে হয় মুঙ্গেরের একটি গোটা কারখানাই যেন কলকাতায় উঠে এসেছে। অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম থেকে কারিগর, সব এসেছে মুঙ্গের থেকেই। আফতাব নিজে ভাগলপুরের বাসিন্দা বলে ওই কারিগরদের জোগাড় করা সহজ হয়েছিল। আফতাবের কারখানা ঘিরে রবীন্দ্রনগরের ওই তল্লাট যেন হয়ে উঠেছে ‘মিনি মুঙ্গের’।
সেই সঙ্গে একটি প্রশ্নের উত্তরও পাচ্ছে পুলিশ। যে প্রশ্নটা উঠেছিল বছর দুই আগে। হরিদেবপুরে পানশালা কাণ্ড এবং মধ্যমগ্রাম ব্রিজে মোটরবাইক থেকে গুলি চালিয়ে এক প্রোমোটারকে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার সময়ে। এত গুলি কোথায় পাচ্ছে দুষ্কৃতীরা? সেই থেকে টের পাচ্ছিল পুলিশ যে, বন্দুক আর কার্তুজের জন্য এখন আর উজিয়ে মুঙ্গের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অস্ত্র তৈরি হচ্ছে কলকাতাতেই। এ বার সেই কারখানার সন্ধান মিলল।
অহেদ হোসেন ও মহম্মদ আসলাম নামে মুঙ্গেরের যে দুই কারিগরকে গ্রেফতার করেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা পুলিশ, তারা এক-একটি ওয়ান শটার বা দেশি বন্দুক তৈরির মজুরি নিত এক হাজার টাকা। বন্দুক তৈরির ওই দুই কারিগর বছর তিনেক আগেই এখানে এসে কাজ শুরু করে। তদন্তকারীদের দাবি, এক-এক জন মাসে গড়ে প্রায় ১৫০টি ওয়ান শটার তৈরি করেছে বলে জেরায় জানিয়েছে দুই কারিগর। এমনই দাবি করছেন পুলিশকর্তারা।
পুলিশ জানায়, কারখানা থেকে শতাধিক ওয়ান শটার ও চারটে নাইন এমএম পিস্তল মিলেছে। সঙ্গে কয়েকশো কার্তুজ। ওই বাড়িতে তল্লাশি চালানোর সময়ে তা দেখে চক্ষু চড়কগাছ দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপের গোয়েন্দাদের।
এক তদন্তকারী অফিসার জানান, কারখানায় রয়েছে গ্যাস কাটার, ড্রিল মেশিন-সহ অস্ত্র তৈরির সব সরঞ্জাম। অধিকাংশ যন্ত্রই মুঙ্গের থেকে নিয়ে আসা হয়েছে বলে জেরায় জানিয়েছে ধৃত আফতাব। কিছু কাঁচামাল শুধু এখানকার বড়বাজার এলাকায় কয়েকটি দোকান থেকে কেনা হত। ওই দোকানগুলিও শনাক্ত করা হয়েছে।
তবে পুলিশ জেনেছে, মাস চারেক ধরে ওই কারখানায় নাইন এমএম পিস্তল তৈরি বন্ধ। কারণ ওই অস্ত্র তৈরির কারিগর মাস চারেক হল মুঙ্গের ফিরে গিয়েছে। প্রচুর অর্ডার থাকা সত্ত্বেও নাইন এমএম তৈরি বন্ধ রাখতে তাই বাধ্য হয়েছে আফতাব।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী বলেন, ‘‘কারখানার মালিক-সহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই কারখানায় তৈরি অস্ত্র বিক্রি করত মূলত দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং থানার বাসিন্দা নিজাম পুরকাইত ও মহেশতলার বাসিন্দা মহম্মদ সেলিম।’’
জেলা পুলিশকর্তাদের অনুমান, গত তিন বছরে প্রায় কয়েক হাজার ওয়াট শটার ও শতাধিক নাইন এমএম বিক্রি করেছে ধৃতেরা। তাদের জেরা করে জানার চেষ্টা হচ্ছে, কোথায় কোথায় ওই অস্ত্র বিক্রি করা হয়েছে। তদন্তকারীদের অফিসারদের দাবি, আফতাবের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকায় ওয়ান শটার কিনে তা স্থানীয় এজেন্টদের সাড়ে চার-পাঁচ হাজারে বিক্রি করত নিজাম ও সেলিম। স্থানীয় এজেন্টরা ওই অস্ত্র বিক্রি করত ছ’-সাত হাজার টাকায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy