কৌতূহলী: শুভব্রতর বাড়ির সামনে উঁকিঝুঁকি স্থানীয়দের। বৃহস্পতিবার, বেহালায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
মায়ের মৃত্যুর পরে তিন বছর ধরে কেন তাঁর দেহ সংরক্ষণ করল ছেলে? বেহালার জেমস লং সরণিতে ফ্রিজার থেকে সেখানকার বাসিন্দা বীণা মজুমদারের দেহ উদ্ধারের পরে এমনই প্রশ্ন উঠেছে পড়শিদের পাশাপাশি সমাজতাত্ত্বিক এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মনেও। শুধুই কি মায়ের নামে আসা মোটা পেনশনের লোভ, না কি কোনও মানসিক দুর্বলতা— কীসের বশে এমন ঘটনা ঘটাল শুভব্রত মজুমদার নামে ওই যুবক, তা ভেবেই পাচ্ছেন না তার পরিচিতেরা।
স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, ছোটবেলা থেকেই অতি আদরে বড় হয়েছে শুভব্রত। বাবা-মা দু’জনেই ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন। একমাত্র ছেলের কোনও শখ-আহ্লাদেই টান পড়েনি কখনও। বরং না চাইতেই চলে আসত অনেক কিছু।
প্রতিবেশী সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর বিয়াল্লিশের শুভব্রতর ছোটবেলা থেকেই খেলায় আগ্রহ ছিল। তাই যে সময়ে তার পড়শিদের বাড়িতে সাদা-কালো টেলিভিশনও ছিল বিলাসিতা, তখন শুভব্রতের জন্য বাবা-মা কিনে এনে দিয়েছিলেন দামি রঙিন টেলিভিশন। বাড়িতে বসেছিল উন্নত মানের ডিশ অ্যান্টেনা। যার সাহায্যে রাশিয়া, আমেরিকা, স্পেনের খেলা দেখার সুযোগ পেত সে।
আরও পড়ুন:
তিন বছর ধরে মায়ের দেহ ফ্রিজে লুকিয়ে রাখলেন ছেলে! বেহালায় চাঞ্চল্য
সংরক্ষণ কী ভাবে, কাটছে না ধোঁয়াশা
দক্ষিণ কলকাতার নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হলেও দু’বছর পরপর পাশ করতে না পারায় শুভব্রতকে সেই স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। পরে অবশ্য নিউ আলিপুরের এক স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে লেদার টেকনোলজি নিয়ে পড়ে শুভব্রত। পড়শিরা জানান, বরাবর শান্ত স্বভাবের ওই যুবক যে এমন ঘটাতে পারে, তা ভাবতেই পারছেন না তাঁরা।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, মায়ের পেনশনের টাকার লোভেই এমন ব্যবস্থা করেছিল সে। পড়শিদের দেওয়া তথ্যও ইঙ্গিত দিচ্ছে তেমন। অনেকেই মনে করছেন, যে বিলাসবহুল জীবন সে যাপন করে অভ্যস্ত, তা হয়তো একার আয়ে কুলিয়ে উঠতে পারত না। তবে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বিষয়টিকে মোটেই সহজ ভাবে দেখতে নারাজ। তাঁর প্রশ্ন, শুধু মায়ের পেনশনের টাকা তোলার জন্য মায়ের দেহ সংরক্ষণ করা খুব প্রয়োজন কি? এই ঘটনার আরও কয়েকটি স্তর আছে বলেই মনে করেন তিনি। অভিজিৎবাবু বলেন, ‘‘এই যুবকের যে মাকে ভীষণ প্রয়োজন, ঘটনাটি থেকে তা স্পষ্ট। তবে তা শুধু মায়ের অর্থ, সেটা ভেবে নেওয়ার কারণ নেই।’’ বরং তাঁর বক্তব্য, মায়ের কাছে যতটা প্রশ্রয় পেত শুভব্রত, মায়ের মৃত্যুর পরে তা পূরণ করার কেউ থাকবে বলেই হয়তো এমনটা ঘটিয়েছে সে। এমন তো নয় যে ব্যাঙ্ক থেকে বীণাদেবীর খোঁজ করলে শুভব্রত মায়ের দেহ দেখিয়ে পার পেত। এত বুদ্ধি যার, সে অবশ্যই এমন কিছু ভাবেনি বলেই মত অভিজিৎবাবুর। পড়়শিরা জানাচ্ছেন, আশপাশের লোকেদের সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা পছন্দ করত না শুভব্রত। প্রতিবেশীরা তাকে যেতে-আসতে দেখলেও তার বিষয়ে বিশেষ কিছুই জানতেন না। তা শুনে সমাজতত্ত্বের শিক্ষকের ব্যাখ্যা, ওই যুবকের হয়তো একমাত্র কাছের মানুষই ছিলেন তার মা। তাই মায়ের মৃত্যুর পরেও মায়া কাটাতে পারেনি ছেলে।
মনোবিদ মোহিত রণদীপের আবার মনে হচ্ছে, মা এতই আগলে রেখে বড় করেছেন ছেলেকে, যে তার সব অনুভূতিই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মনোবিদ বলেন, ‘‘শুভব্রতকে হয়তো কখনও কোনও দায়িত্বই নিতে হয়নি আর্থিক ভাবে। তাই মায়ের মৃত্যুর পরে যখন একটা বড় ভরসা চলে যাচ্ছে, তখন এ ভাবেই হয়তো শেষ সম্বলটুকু ধরে রাখতে চেয়েছে সে।
তবে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার মাঝে কোনও ভাবেই অপরাধের দিকটি হাল্কা হয়ে যেতে দিতে নারাজ মনোরোগের চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব। তাঁর বক্তব্য, শুভব্রতর কোনও মানসিক বিকৃতি আছে কি নেই, সে প্রসঙ্গ পরে আসবে। তার আগে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে ঘটনাটি মারাত্মক ভাবেই অপরাধমূলক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy