শহর জুড়ে প্রতিবাদ।
মেট্রোর ঘটনাটা শুনেছেন? পার্ক স্ট্রিট স্টেশন থেকে বেরোনোর মুখে প্রশ্নটা শুনেই খেঁকিয়ে উঠলেন এক পঞ্চাশোর্ধ্ব। হাঁটার গতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘মেট্রোর দরজার সামনেটা তো বাড়ির ব্যালকনি হয়ে গিয়েছে। কাউকে মারধর করা ঠিক নয়। তবে এদের জন্য খুব সমস্যা হয়। এক বার যেখানে নামার কথা, তার দু’টো স্টেশন পরে গিয়ে নামতে হয়েছিল।’’
পাশে দাঁড়ানো এক মহিলার সংযোজন, ‘‘অনেকে আবার এমন ভাবে সঙ্গীকে নিয়ে মেট্রোয় ওঠেন, যেন সেই সঙ্গী কিছুই বোঝেন না। কোথায় দাঁড়াতে হবে, কোথায় বসতে হবে, পারলে হাতে ধরে সব দেখিয়ে দেন। পরে সেই অভিভাবক সুলভ হাবভাবই বদলে যায় গভীর পাকামিতে। তার পরের দৃশ্য আর দেখার নয়। ভারী অস্বস্তি হয়।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায় পাল্টা বললেন, ‘‘যাঁদের জীবনে প্রেম নেই, তাঁরাই হিংসে করছেন। এটাই ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া! এখানে প্রকাশ্যে চুমু, আলিঙ্গন অপরাধ। অথচ, ভারত জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বে দ্বিতীয়!’’
মেট্রোয় ‘আপত্তিকর’ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার অভিযোগে গত সোমবার এক যুগলকে দমদম স্টেশনে মারধরের ঘটনা ঘটে। খবর ছড়িয়ে পড়তেই নানা মহল থেকে শুরু হয় প্রতিবাদ। বুধবার এ নিয়ে শুরু হয়েছে ‘হোক আলিঙ্গন’। অনেকেই এর সঙ্গে ২০১৪ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের চুমু-আন্দোলনের মিল পাচ্ছেন। সেই সময়ে স্লোগান উঠেছিল, ‘আমার শরীর, আমার মন। দূর হটো রাজশাসন’। ওই বছরই কোচির মেরিন ড্রাইভে ‘কিস অব লাভ’ আন্দোলন হয়। এই দুই আন্দোলনই ছিল নীতি পুলিশির বিরুদ্ধে।
বুধবার দিনভর শহরের নানা প্রান্তে ঘুরে দেখা গেল, প্রায় সব আড্ডাতেই ঘুরেফিরে আসছে মেট্রোয় যুগল নিগ্রহের প্রসঙ্গ। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে বান্ধবী অদিতি বিশ্বাসের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিলেন গবেষক-ছাত্র সৈকত সিংহ। তাঁর মতে, ‘‘কড়া আইন প্রয়োজন। অনেক সময়ে কিছু না করেই আক্রমণের শিকার হতে হয়। যে কোনও দিন আমাদের সঙ্গেও এমনটা হতে পারে।’’ কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে আসা স্নেহা সাহা আবার বললেন, ‘‘শুধু বয়স্করাই নন, যুগলকে একা পেলে অনেক তরুণ-তরুণীর দলও উত্ত্যক্ত করে। আসলে অন্যকে অস্বস্তিতে ফেলে মজা পাওয়াটা দস্তুর হয়ে যাচ্ছে।’’
শহরের এক শপিং মলে কলেজপড়ুয়া তরুণী জানালেন, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে প্রিন্সেপ ঘাটে বসেছিলেন বন্ধুর সঙ্গে। মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা কিছু যুবক তাঁদের ঘিরে ধরে উঠে যেতে বলেন। প্রতিবাদ করায় তাঁর পুরুষ বন্ধুকে মারধর করা হয়েছিল। থানায় অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি বলে দাবি তাঁর। প্রসঙ্গত, বছর দুই আগে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে শহরের নানা পার্কে হাঙ্গামা বাধানোর অভিযোগ উঠেছিল ‘হিন্দু সংহতি’ নামে একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে।
মেট্রোর ঘটনায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যাঁরা ওই যুগলকে মারধর করেছেন, তাঁরা রাস্তায় প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ দেখে ততটা সরব হন না কেন? রাস্তায় প্রেমিক-প্রেমিকার ঝগড়া, মারামারি দেখেও চুপ থাকেন কেন? পাড়ার মোড়ে ‘রোমিও’দের ঠেকাতে এঁদের তৎপরতা দেখা যায় না কেন? কেন এঁরাই পাশের বাড়ির গার্হস্থ্য হিংসা দেখে, ‘ওটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার’ বলে উড়িয়ে দেন? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের পড়ুয়া সৌমী নন্দী বললেন, ‘‘এই ধরনের মানসিকতা না বদলালে বড় আন্দোলন হবে।’’
আপাতত প্রতিবাদের ভাষা রবীন্দ্রনাথের বাণীও। সোশ্যাল সাইটের দেওয়াল ভরে লেখা— ‘...রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy