ভিক্ষা: কাচ তোলা গাড়ির জানলায় ভিখারিণী ‘মা’। ঘুমিয়ে আছে শিশুটি। ছবি: রণজিৎ নন্দী
শরীরের এক ফালি মলিন কাপড়ে লজ্জা ঢাকছে হাঁটুর উপর পর্যন্ত। কাঁখে উলঙ্গ শিশু। পাশে ছোট ছোট পায়ে তাল মিলিয়ে চলেছে আরও দুই নগ্ন বালক। রোদে ঝলসানো হাড়সর্বস্ব শরীরের এক হাতে ধরা ভাঙা পাত্র। দু’মুঠো ভাতের ভিক্ষা চেয়ে সেই মায়ের প্রবল আকুতিতে তত ক্ষণে পাড়ার এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে উঁকিঝুঁকি শুরু হয়ে গিয়েছে। এ দৃশ্য এখন দেখা যায় না। বরং ফুটপাতের ধারে অথবা স্টেশন চত্বরের ভিখারিনি মায়েদের অহরহ চোখে পড়ে। কোলে টানটান শুয়ে শিশু। কখনও কখনও বদলেও যায় কোলের শিশুটি। কিন্তু বদলান না মা। সত্যিই এঁরা মা তো?
হাওড়া, শিয়ালদহ, দমদম স্টেশন চত্বরে, নন্দন-রবীন্দ্র সদন, ধর্মতলা এলাকায় ওঁদের কারও কারও দেখা মিলবে। এ ছাড়াও ওঁদের আরও ঠিকানা রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে জিপিও-র সামনে সন্তান কোলে ভিক্ষা করেন এক মহিলা। যাঁরা নিয়মিত ওই পথে যাতায়াত করেন, তাঁরা কোনও দিন সেই মাকে ঘোমটা ছাড়া দেখেননি। তাঁর কোলের শিশুটিকেও জেগে থাকতে দেখেননি কেউ। হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোয় সে।
শৈশব চুরি হয়ে যাওয়া এই শিশু প্রায় সব সময়েই ঘুমিয়ে থাকে। কখনও মা, কখনও বা ভাই-বোনের কোলে। হাজারো টানা-হ্যাঁচড়াতেও চোখ খোলে না ওরা। ওরাই বিজ্ঞাপন, ভিক্ষার বিজ্ঞাপন। এই ভূমিকাই ওদের জন্য বরাদ্দ।
কথা হচ্ছিল দমদম স্টেশন চত্বরের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তাঁর মতে, ভিক্ষা নয়, এ তো ব্যবসা। মা বা ভাই-বোন নয়, ওঁরা আসলে ভাড়া করা কলাকুশলী। এই পেশায় সব থেকে বেশি চাহিদা শিশুদের। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শহরে ছাড়লে ন্যূনতম দৈনিক ২০০ টাকা ভাড়া জোটে পরিবারের। ওদের রাখলে সারা দিনের উপার্জন প্রায় ৪০০ টাকা। পার্ক স্ট্রিটের মতো জায়গায় হিসেবটা ৬০০ ছাড়িয়ে যায়। এর পরেই কিন্তু সব থেকে বেশি চাহিদা রয়েছে বৃদ্ধ মুখের।
সবটাই ঠিক করে দেওয়ার জন্য রয়েছে সংস্থা। তবে তা এক না অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তুলে নিয়ে আসা হয়। এ জন্য জন সচেতনতাও প্রয়োজন।
সামাজিক ন্যায় এবং ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের সাম্প্রতিক রিপোর্টে এ রাজ্যের ছবিটা বেশ আতঙ্কের। মন্ত্রী থেবরচন্দ গহলৌত জানিয়েছেন, আশ্রয়হীন ও ভিখারির তালিকায় এ দেশে সবার উপরে পশ্চিমবঙ্গ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ এবং অন্ধ্রপ্রদেশ।
জন সচেতনতার কথা যতই বলা হোক, প্রশাসন কিন্তু ঘুমিয়েই। এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে বছর কয়েক আগের উত্তর শহরতলির একটা ঘটনা। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথে স্টেশনে ঘুমন্ত বাচ্চা কোলে এক ভিখারিনিকে দেখতে পেতেন এক দিদিমণি। এক দিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় তাঁর। সরাসরি প্রশ্ন করেন, রোজ বাচ্চাটা ঘুমোয় কেন? যথারীতি অসুস্থতার গল্প শোনান সেই ভিখারিনি। নাছোড়বান্দা শিক্ষিকা চিকিৎসার কাগজ চেয়ে জেরা শুরু করতেই পালানোর চেষ্টা করেন সেই মহিলা। অবশেষে পুলিশের জালে একাই ধরা পড়েন তিনি। কিন্তু কান টানলেও বেরিয়ে আসে না মাথা। কারণ কান আর মাথার যোগ ছিল সুতো দিয়ে। জালে কান আটকাতেই নির্দেশ আসে সুতো কেটে দেওয়ার।
তবে বেরিয়ে আসে সেই ভয়াবহ তথ্য, শিশুটি তাঁর কেউ নয়। প্রতিদিন তাঁকে ইঞ্জেকশন দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখা হত। খিদে আর শৈশবের ইচ্ছেগুলো এ ভাবেই ঘুম পাড়িয়ে রেখে অন্যের পেট ভরায় ওরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy