বিষ-বাষ্প: গাড়ির কালো ধোঁয়া বাড়াচ্ছে দূষণ। বৃহস্পতিবার, ধর্মতলায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
বায়ুদূষণের উৎসের খোঁজে করা একটি সমীক্ষায় পুর শ্মশানগুলিতে কাঠের চুল্লিতে ব্যবহৃত কাঠের পরিমাণ সম্পর্কে কলকাতা পুরসভার কাছে তথ্য চেয়েছিল ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নিরি)। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান দিয়ে পুরসভা জানিয়েছিল, তাদের অধীনস্থ শ্মশানে মৃতদেহ সৎকারে সেই বছর প্রায় ৭৬৫.৬৪ মেট্রিক টন কাঠ লেগেছিল।
পুরসভার নিমতলা শ্মশানে কাঠ সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থার এক কর্তা জানাচ্ছেন, মাসে গড়ে ৩০০টি দেহ দাহ করতে বর্তমানে ৭০ টনের মতো কাঠ লাগে। তাঁর কথায়, ‘‘তবে ২০১৫ সাল থেকে চুল্লিতে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র থাকায় দূষণ রোধ করা গিয়েছে।’’
যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, কাঠের চুল্লির দূষণ না-হয় নিয়ন্ত্রণ করা গেল। কিন্তু, রাস্তার যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া-দূষণ রুখবে কে? কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দূষণ রোধে বৈদ্যুতিক, সিএনজি বা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি-চালিত যানবাহনের কথা বললেও বাস্তব থেকে তার দূরত্ব শত যোজন! অটোমোবাইল শিল্প সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি গত বছরের শেষে নিজেদের রিপোর্টেই যেমন বলেছে—‘বর্তমানে দেশে ইলেকট্রিক যানবাহন চলাচলের পরিকাঠামো মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়।’
গবেষণাকারী সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ (সিএসই)-এর তথ্য বলছে, ১৯৫১-২০১৬ পর্যন্ত দেশে মোট যান রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা ৭০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মধ্যে শুধু ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যার ক্ষেত্রেই প্রথম এক কোটির মাত্রা ছুঁতে সময় লেগেছিল প্রথম ৫৫ বছর। আর পরের ১০ বছরে ব্যক্তিগত গাড়ি নথিভুক্ত হয়েছে দু’কোটি!
সেখানে গত জুলাই পর্যন্ত দেশে মোট বৈদ্যুতিক যানবাহনের সংখ্যা মাত্র পাঁচ লক্ষের মতো। কেন্দ্রের ভারী শিল্প মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দেশে নথিভুক্ত বৈদ্যুতিক যানের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১.৩১ এবং ১.৬ লক্ষ। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এক লক্ষ বৈদ্যুতিক গাড়ি নথিভুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশের মোট যান-সংখ্যার মাত্র এক শতাংশ বৈদ্যুতিক গাড়ি চলছে।’’
অথচ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সুরেই চলতি মাসে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও দাবি করেছেন, ‘‘২০৩০ সালের মধ্যে কলকাতায় বৈদ্যুতিক ও সিএনজি গাড়িই চলবে, দূষণ ছড়ায়, এমন গাড়ি নয়।’’ যদিও কোন জাদুকাঠির স্পর্শে তা সম্ভব হবে, সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের কথায়, ‘‘পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সময় লাগলেও বৈদ্যুতিক গাড়িই ভবিষ্যৎ।’’
পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০০৪-২০১৮, এই ১৫ বছরে কলকাতায় আক্ষরিক অর্থেই যান বিস্ফোরণ হয়েছে। এই সময়কালে কলকাতায় নথিভুক্ত গাড়ির সংখ্যা ১১ লক্ষ। যার হাত ধরে ভারী ও দূষিত হয়ে পড়েছে শহরের বাতাসও। বিশেষ করে শীতকালে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গণেশকুমার দাস বলছেন, ‘‘শীতকালে বাতাসের গতি মন্থর হলে দূষণের মাত্রা তুলনামূলক ভাবে বেড়ে যায়।’’ সিএসই-র এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি) অনুমিতা রায়চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘শীতকালীন দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা কঠোর ভাবে প্রয়োগ করা দরকার।’’
যানবাহনের ধোঁয়ার কারণে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের মাত্রাও অতিরিক্ত হারে বাড়ছে শহরের বাতাসে। সিএসই-র গবেষণা জানাচ্ছে, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, মুম্বই-সহ সব মেগা সিটির মধ্যে শুধু দিল্লি ও কলকাতাতেই এই দূষকের স্বাভাবিক মাত্রা গত সাত বছরে ধারাবাহিক ভাবে বেশি থেকেছে।
দূষণ কমানোর অন্যতম পন্থা পুরনো গাড়ি বাতিল করা। কারণ, দেশের মোট যানবাহনের তুলনায় পুরনো গাড়ির হার মাত্র পাঁচ শতাংশ হলেও কেন্দ্র জানাচ্ছে, মোট দূষণের ৬৫-৭০ শতাংশের নেপথ্যে রয়েছে পুরনো গাড়ি। ভারী শিল্প মন্ত্রকের এক কর্তা বলছেন, ‘‘যেমন, কোনও ভারত স্টেজ-১ (গাড়ির ধোঁয়া থেকে বায়ুদূষণ মাপার মাপকাঠি হল ‘ভারত স্টেজ’) ভারী ডিজ়েল-চালিত গাড়ি ভারত স্টেজ-৬ গাড়ির থেকে ৩৫ শতাংশ বেশি দূষণ ছড়ায়।’’
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দাবি, জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ মতো ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ১.১৪ লক্ষ পুরনো গাড়ি বাতিল করা হয়েছে। নোটিস জারি হয়েছে ১.৮০ লক্ষ গাড়ির ক্ষেত্রে। যদিও একটি মামলায় কেন্দ্রীয় সরকার পরিবেশ আদালতে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিল, কলকাতার রাস্তায় চলাচল করা ১৫ বছরের পুরনো বাণিজ্যিক এবং অ-বাণিজ্যিক গাড়ির সংখ্যা যথাক্রমে ২.২ লক্ষ এবং ১৮ লক্ষের মতো। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘শহরের রাস্তায় পুরনো গাড়ি চলার বিধিনিষেধ নিয়ে কলকাতা
হাই কোর্ট, জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সরকার নির্দেশিকা জারি ছাড়া আর বিশেষ কিছু করেনি।’’ প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে বিএস-৬ চালু হওয়ার কথা থাকলেও তা কার্যকর না হওয়ায় বছরখানেক আগে পরিবেশ আদালত মন্তব্য করেছিল, ধাপে ধাপে বিএস-৪ যানবাহন বাতিল করা না হলে জনসাধারণের বিশ্বাসভঙ্গের জন্য শুধুমাত্র রাজ্য সরকার দায়ী থাকবে।
তবে পুরনো গাড়ি বাতিলের ক্ষেত্রেও রাজনীতি অমোঘ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। এক পরিবেশবিদের কথায়, ‘‘কেন্দ্র-রাজ্য পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় বৈদ্যুতিক গাড়ির কথা বললেও তার পরিকাঠামো কোথায়? ক’টা চার্জিং স্টেশন রয়েছে? ফলে সব কিছুর মতো বৈদ্যুতিক গাড়ির বিষয়টিও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার রূপ নিলে তা দুর্ভাগ্যের।’’
যেমনটা দুর্ভাগ্যের গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসবায়ুতে মিশতে থাকা বিষ-বাষ্পের পরিমাণও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy