হায়, এ কী সমাপন। রবিবার, বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে। ছবি: সুমন বল্লভ
এতক্ষণ ধরে চেয়ারে বসা যে মেক্সিকান ওয়েভ মেসি প্রতি বার বলে পা ছোঁয়াতেই চেঁচাচ্ছিল, উঠছিল-নামছিল, ম্যাচের ১১৩ মিনিটের মাথায় সেই ঢেউই একেবারেই নিশ্চল। গোটজে-র পা থেকে বল জালে জড়াতেই চুরমার চব্বিশ বছরের স্বপ্ন।
ক্লাবের মধ্যে রাখা পটকা। আর্জেন্তিনার বিশাল বিশাল পতাকা। পাশের রাস্তায় রাখা নীল-সাদা রঙের একটি গাড়ি। নীল-সাদা বেলুনে সাজানো। ঠিক ছিল আর্জেন্তিনা জিতলে ওই গাড়ি প্রদক্ষিণ করবে গোটা পাড়া। প্রথম হাফে ইগুয়েন পা ছুঁইয়ে বল জার্মানির জালে জড়াতেই বাবলু, ছোটু, তিমির, বাপিদের গোটা দলটা নেমে পড়েছিল রাস্তায়। বেশ কয়েকটা বাজিও ফাটল। সেই এক বারই। রবিবার গোটা রাতে আর বাজি ফাটানোর দরকার পড়ল না।
কলকাতা না বুয়েনস আইরেস? বোঝা দায়!
বড় রাস্তা থেকে গলিতে ঢুকতেই নীল-সাদা আলোয় সাজানো আর্জেন্তিনার জাতীয় পতাকা। পাশে মেসির বিশাল কাট-আউট। হাতে বিশ্বকাপ। আরও কিছুটা এগিয়ে মনে হল যেন আর্জেন্তিনারই পাড়া। রাস্তার উপরে লম্বালম্বি টাঙানো দড়িতে আজের্র্ন্তিনার পতাকার পাশাপাশি নীল-সাদা রিবন। পাশাপাশি নেইমার, রোনাল্ডো আর মেসির তিনটি বড় কাট-আউট। তবে আলোকিত শুধু মেসি-ই। বাকি দু’জন বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছেন আগেই।
নীল-সাদা পতাকা আর রিবনের মাঝে মধ্যে কোথাও কোথাও দু’একটা জার্মানির পতাকা। তবে মুলার, ক্লোসে-দের ছবি নেই। জানা গেল, এলাকায় হাতে গোনা যে ক’জন ব্রাজিল সমর্থক ছিলেন, তাঁরাই টাঙিয়েছেন জার্মানির পতাকা। তবে আর্জেন্তিনার সমর্থকদের ভিড়ে তাঁদের কারওরই দেখা মেলেনি। ক্লাবের পাশে তাঁবু খাটিয়ে বসে বিশ্বকাপ-দর্শন। যেন স্টেডিয়ামেই খেলা দেখা! মেসির এক-একটা মুভমেন্টের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে দর্শকেরা উঠছেন, বসছেন। মেক্সিকান ওয়েভ। রাতদুপুরে গমগম করেছে গোটা পাড়া।
পাড়ার নাম গাঙ্গুলিবাগান। গত এক মাস ধরে আর্জেন্তিনার ১০ নম্বর জার্সি পরে ঘুরে বেরিয়েছে এ তল্লাটের কচি-কাঁচারা। আর্জেন্তিনার ম্যাচের দিনগুলোয় মুখে রং মেখে রাত জেগেছে। ব্রাজিল ম্যাচ হারলেও রীতিমতো উৎসব। পটকা ফেটেছে, হইচই-হুল্লোড়।
তবে রবিবার রাতটা ছিল রীতিমতো স্পেশাল। হাফ-টাইম পর্যন্ত গোল হয়নি। রাতজাগা দর্শকদের দলটার চোখে-মুখে আশঙ্কার ছাপ। রীতিমতো হোমওয়ার্ক করেই খেলা দেখতে বসেছে ওরা। এক মাস ধরে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বিবৃতিও দিতে হয়েছে। রবিবার প্রথম হাফে গোল না হওয়ায় ফিরে এসেছিল ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের স্মৃতি।
ক্লাস সেভেনের বাবলু বা তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী অরিন্দম। দু’জনেরই মুখ নীল-সাদায় রাঙানো। ‘সে বারও ফাইনালে আর্জেন্তিনা-জার্মানি মুখোমুখি হয়েছিল। প্রথম হাফে কোনও পক্ষেই গোল না হওয়ার পর পরের হাফে গোল দিয়ে জিতে যায় জার্মানি। এ বারও কি তা-ই হবে? একটা গোল অফসাইডে বাতিল। মেসি, ইগুয়েন গোল মিস করায় তেমনই মনে হচ্ছে যেন! কাউকে বলতে পারছি না।” বলছিলেন অরিন্দম।
শুধু গাঙ্গুলিবাগানই-বা কেন, রবিবার শেষ রাতে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় হতাশায় ভেঙে পড়েছেন শহরের আর্জেন্তিনার সমর্থকেরা। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে একটি বেসরকারি হাসপাতালের সামনের মাঠে বড় প্রোজেক্টরে খেলা দেখার ভিড়। নানা দিক থেকে এসে জড়ো হয়েছিলেন প্রায় হাজারখানেক আর্জেন্তিনা সমথর্ক। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে ছোট থেকে বড় কেউ ছড়া কেটেছেন, কেউ নাচে-গানে-উল্লাসে মেতেছেন এক্সট্রা টাইম পর্যন্ত। দলের জার্সিতে, রঙে, ড্রাম ও বাঁশির আওয়াজে এ যেন অন্য কলকাতা।
১১৩ মিনিটের মাথায় স্তিমিত হয়ে এল এতক্ষণের সব উল্লাস-উত্তেজনা। শেষ রাতে ফেরার সময়ে ওই মাঠেই ভাঙা হাট। এখানে ওখানে পড়ে মুচড়ে দেওয়া বাঁশি, নীল-সাদা রিবন, মেসি-সাবেল্লার ছবি। বিশ্বকাপ শেষ। সোমবার থেকে কলকাতা ফিরে আসছে সেই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের কলকাতাতেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy