আলোচনা: বক্তৃতা দিচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। মঞ্চে (বাঁ দিক থেকে) আশিস রাজাধ্যক্ষ, কৌশিক ভৌমিক এবং মধুজা মুখোপাধ্যায়। সোমবার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। নিজস্ব চিত্র
ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরপরই কি শহরের গা থেকে ‘কলোনিয়াল’ বা ঔপনিবেশিকতার গন্ধ পুরোপুরি হারিয়ে গিয়েছে? না কি তা আদৌ হওয়া সম্ভব?
যে শহরের উত্থান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত ধরে, তার পরে ডালপালা বিস্তৃত করে ভৌগোলিক গুরুত্বের দিক থেকে ক্রমশই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতার উৎসকেন্দ্র হয়ে ওঠা, সে শহরের মজ্জায় মজ্জায় ঔপনিবেশিক গন্ধ যে থাকবে, তা নিয়ে মত থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তা রয়েছেও।
কিন্তু প্রতি-প্রশ্নও তো রয়েছে। ইতিহাসগত ভাবে বেড়ে ওঠার এমন ধারাবিবরণী যে শহরের, সেই কলকাতা বর্তমানে কতটা ঔপনিবেশিক শহর, তা নিয়েও তো প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের যে অনতিক্রম্য এক ব্যবধান তৈরি হয়েছে, যা শহরের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কাঠামোকে ভেঙেচুরে দিয়েছে, যার সঙ্গে শহরের নিজস্ব ঔপনিবেশিক ইতিহাসের কোনও মিলই নেই। সোমবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ‘ইজ কলকাতা আ কলোনিয়াল সিটি’ বা ‘কলকাতা কি ঔপনিবেশিক শহর’ শীর্ষক আলোচনাসভায় এই প্রশ্নগুলোই উস্কে দিলেন সমাজবিজ্ঞানী-ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পার্থবাবু নিজস্ব প্রাজ্ঞ শৈলীতে কলকাতাকে এখনও এক ঔপনিবেশিক শহর হিসেবে দেখার প্রথাগত চিন্তা-দর্শনের মূলেই সজোরে আঘাত করলেন।
তিনি জানালেন, কলকাতা আর মোটেই ঔপনিবেশিক শহর নেই। কলকাতা বন্দরের ক্রমহ্রাসমান গুরুত্ব এবং অতঃপর ‘মৃত্যু’ ও রাইটার্স বিল্ডিং থেকে প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয়ের সরে যাওয়া কলকাতার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের শেষ চিহ্ন। পার্থবাবু বললেন, ‘‘কলকাতা আর মোটেই ঔপনিবেশিক শহর নয়। কলকাতার ঔপনিবেশিক স্পিরিট রয়েছে কি না, তা বিতর্কের বিষয়।’’
এ দিনের বক্তৃতায় পার্থবাবু ব্রিটিশ শাসনকাল, স্বাধীনতা-স্বাধীনোত্তর পর্ব থেকে শুরু করে শহরের মিশ্রিত জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সময়ে একই শহরের মধ্যে সাহেব ও ভারতীয়দের সমান্তরাল বেঁচে থাকা, সেনাদের সদর দফতরের উপস্থিতি, কলকাতা পুরসভার পত্তন, স্বাধীনোত্তর সময়ে শহরের রাস্তায় মিটিং-মিছিলের স্রোত-সহ বহুধা শাখায় কলকাতার বেড়ে ওঠাকে বিধৃত করেন। তাঁর বক্তৃতায় বাদ যায়নি শহরের দাঙ্গার ইতিহাস, বর্তমানে হেরিটেজ নিয়ে সারা শহরে যে আলোচনা চলছে সে প্রসঙ্গও। শেষ পর্যন্ত বাদ যায়নি ফুটবলও! কিন্তু সে প্রসঙ্গের মাধ্যমেও পার্থবাবু স্পষ্ট করে বললেন, কলকাতার ঔপনিবেশিক ইতিহাস থাকতে পারে, কিন্তু সেই ইতিহাসের সামঞ্জস্য রাখার জন্য প্রয়োজনীয় চিন্তন বা অর্থনীতির প্রয়োজন ছিল, তা ‘ব্যর্থ’ হয়েছে! পার্থবাবু বললেন, ‘‘আমরা ছোটবেলায় এখানে ফুটবল খেলেছি। কিন্তু এখনকার প্রজন্মের কাছে ফুটবল মানে বার্সেলোনা! ইংরেজি ভাষায় কথা বলা প্রজন্মকে ঔপনিবেশিক কলকাতা আর
টানে না!’’
ফলে ইতিহাসে হয়তো ঔপনিবেশিক গন্ধ রয়েছে, কিন্তু কলকাতা আর ঔপনিবেশিক শহর নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy