ঘিঞ্জি: ট্যাংরার বস্তি এলাকায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে ঘর। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
দূর থেকে দেখে মনে হয়, যেন উল্টোনো ছাতা। গিজগিজে ঘর ঘিরে রয়েছে ছাতার ডাঁটির মতো দাঁড়িয়ে থাকা ঝাঁ-চকচকে বহুতলকে। সেখানে ঢোকা-বেরোনোর রাস্তাটুকু ছাড়া আশপাশের সবই বস্তির দখলে। এক জমির অংশ হয়েও এই দুই পৃথিবীর পার্থক্য অনেক!
এক দিকে ঝকঝকে শৌচাগার-সহ তিন-চার কামরার ফ্ল্যাটে মেরেকেটে চার-পাঁচ জনের বসবাস। নীচেই রয়েছে গাড়িবারান্দা, সুইমিং পুল। অন্য দিকে, বাড়ির বদলে রয়েছে শুধুই ঘর। সেই একটিমাত্র ঘরে কোথাও আট, কোথাও দশ-বারো জনের বাস! মহিলাদের পোশাক বদলের সময়ে পুরুষদের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়। রাতে ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা ঘরে ঘুমোলে বড় ছেলেদের নিয়ে বাবাকে যেতে হয় পথে। কখনও পাড়ার ক্লাবে শোয়ার জায়গা হয় অনেকের সঙ্গে। কোথাও হয়তো কুড়ি-তিরিশটা ঘর মিলিয়ে শৌচালয় মাত্র একটি, কোথাও আবার তা-ও নেই! তখন ভরসা খোলা নর্দমা বা খাল।
কলকাতা শহরের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সংক্রান্ত অভিযোগ সব চেয়ে বেশি বস্তি ঘিরে। পুরসভা সূত্রের খবর, নথিভুক্ত এবং অনথিভুক্ত মিলিয়ে এই মুহূর্তে এ শহরে বস্তির সংখ্যা ৫৭৭৪। সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী, ওই সব বস্তিতে ২০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষের বসবাস। তবে বর্তমানে সংখ্যাটা ৩৬ থেকে ৪০ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে বলেই ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। অর্থাৎ, এ শহরের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বাসিন্দা বস্তিতে থাকেন। অথচ, অধিকাংশ বস্তিতেই এখনও পৌঁছয়নি ন্যূনতম পরিষেবাটুকু। কয়েকটি এলাকায় কিছু বস্তিকে উদ্বাস্তু কলোনি/বস্তি হিসাবে চিহ্নিত করে পাট্টা বা ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে (যেমন, বাগবাজারে ‘মায়ের বাড়ি’ প্রকল্প)। হাটগাছিয়া, ধরবাগান, মিয়াঁবাগান, পঞ্চাননতলা, ক্ষুদিরামপল্লি, মারোয়াড়িবাগান ও ভাঙা মহল্লার মতো হাতে গোনা কিছু বস্তিকে আবার ‘মডেল বস্তি’ হিসাবে তুলে ধরে রাস্তা সংস্কার, নিকাশি, আলো, সৌন্দর্যায়ন ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর কাজ করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলি ব্যতিক্রম। বাকি সবই এখনও অন্ধকারের আড়ালে।
ট্যাংরা-তপসিয়া এলাকার বস্তিতে ঘুরে দেখা গেল, এখনও রয়েছে কাঁচা নর্দমা। পাশেই এবড়োখেবড়ো রাস্তা। বৃষ্টি হলেই নর্দমার জল উঠে আসে ঘরে। যত্রতত্র পড়ে রয়েছে আবর্জনার স্তূপ। সেখানেই প্লাস্টিক টাঙিয়ে বসবাস করছেন অনেকে। পূতিগন্ধময় পরিবেশেই চলছে প্রাথমিক স্কুল। কালীঘাট, ভবানীপুর, আলিপুর ও যাদবপুরের কয়েকটি বস্তিতে আবার দেখা গেল, ঘর বলতে চট পেতে তার উপরে তৈরি ছাউনি। পানীয় জলের তীব্র সমস্যা। সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও জল মিলছে না বহু জায়গায়। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে ১০-১৫ দিন আগে তুলে রাখা অস্বচ্ছ জলই খাচ্ছেন। সেই জলই ধরে রাখা হচ্ছে পুরনো ব্যাটারির ফাঁকা খোলে। উত্তর কলকাতার একটি বস্তিতে আবার ঘিঞ্জি রাস্তায় প্রায় মাথার উপরে নেমে এসেছে বিদ্যুতের তার। যে কোনও মুহূর্তে বিপদ ঘটতে বাধ্য। এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘ভোটের সময়েই শুধু নেতারা আমাদের নিয়ে কথা বলেন। বেঁচে থাকার জন্য যা যা লাগে, তা তো পাই-ই না, উল্টে মৃত্যুফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। গত বর্ষাতেই বস্তি এলাকায় একাধিক লোক বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন।’’
বাসিন্দাদের তাড়া করে বেড়ায় অগ্নিকাণ্ডের ভয়ও। বছর ঘোরার এই সময়ে প্রতি বারই খবর হয় বস্তির অগ্নিকাণ্ড। গত এক বছরে এমন ঘটনা ঘটেছে ১৪টি। যার মধ্যে সব চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল ও বাগবাজারে। নারকেলডাঙাতেও পুড়ে যায় প্রায় ৭০টি ঝুপড়ি। বাসন্তী কলোনি, ট্যাংরা, কালিকাপুর, পার্ক সার্কাস, ব্রেস ব্রিজ ও তিলজলায় বস্তির অগ্নিকাণ্ডও পুলিশ-প্রশাসনের হুঁশ ফেরায়নি বলে অভিযোগ। ঘিঞ্জি এলাকা হলে আগুন নেভাতে গিয়ে প্রায়ই সমস্যায় পড়ে দমকল। কিন্তু তার পরেও দেখা যায়, সরকারি সহায়তা কেমন মিলবে, তা নির্ভর করে বস্তির মানুষের দর কষাকষির ক্ষমতার উপরে। পুড়ে যাওয়া নারকেলডাঙা বস্তিতে স্রেফ ত্রিপল মিলেছে ঘর বাঁধার জন্য। বেঙ্গল কেমিক্যালের কাছে ‘নেতাজি কলোনি’ বা গুলমাঠে আবার পাকা ঘর বানিয়ে দিচ্ছে সরকার, যদিও তার মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। সামনে ভোট। তাই বস্তির ভোটার-সংখ্যাও হিসাবে আসে।
কিন্তু শহরের ‘উন্নয়ন’-এর পরিকল্পনা কি এতগুলো মানুষের এই জতুগৃহে বসবাসের রূঢ় বাস্তবকে অস্বীকার করে হতে পারে? বিদায়ী পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য তথা বস্তি বিষয়ক দফতরের মেয়র পারিষদ হিসাবে দায়িত্ব সামলানো স্বপন সমাদ্দারের দাবি, ‘ঠিকা টেনেন্সি’ ছাড়াও সরকারি বা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি, রেল বা বন্দরের জমি দখল করে এ শহরে বস্তি গড়ে উঠেছে। সরকার বস্তি উচ্ছেদের পক্ষে নয়। বস্তি রেখেই উন্নয়নের কাজ হয়েছে। বস্তির স্বাস্থ্য ফেরাতে গণ-শৌচালয়ও হয়েছে এই সরকারের সময়ে। তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রের ‘ন্যাশনাল স্লাম ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ (এনএসডিপি)-এ যে টাকা আসত, তা এখন বন্ধ। তবু প্রতি বছর বস্তি উন্নয়নে ১৪০ থেকে ১৬০ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ করা হয়। এতটা উন্নয়ন আগে হয়নি।’’
উত্তর কলকাতার হালদারবাগান বস্তির বাসিন্দা, সত্তরোর্ধ্ব নিমাই ঘোষ বললেন, ‘‘১৪৪টা ওয়ার্ডের জন্য ১৬০ কোটি বরাদ্দ হলে এক-একটি ওয়ার্ডের বস্তি উন্নয়নেই এক কোটির বেশি! এত টাকা এলেও খালে শৌচকর্ম করতে যান কেন বাসিন্দারা?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy