Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

ভুল না ভানুমতীর খেল্‌? হরিদেবপুরে ‘ভ্রূণ’গুলো হয়ে গেল মেডিক্যাল বর্জ্য!

হরিদেবপুরের একটি ফাঁকা জমি পরিষ্কার করতে গিয়ে কয়েকটি প্লাস্টিকের ব্যাগে ১৪টি মানবভ্রূণ ও নবজাতকের দেহ উদ্ধারের ‘খবর’ শুনে সকালেই পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অকুস্থলে পৌঁছে যান কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমার স্বয়ং। যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) প্রবীণ ত্রিপাঠী, ডিসি (সাউথ-ওয়েস্ট) নীলাঞ্জন বিশ্বাস তো ছিলেনই। প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি এমআর বাঙুর হাসপাতালে পাঠানো হয় ময়না-তদন্তের জন্য।

সরেজমিন: হরিদেবপুরে ঘেরা জমিতে তদন্তকারীরা। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র।

সরেজমিন: হরিদেবপুরে ঘেরা জমিতে তদন্তকারীরা। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:১৬
Share: Save:

ছিল রুমাল। হয়ে গেল বিড়াল! তাতে যাবতীয় হাতযশ জাদুকরেরই।

ছিল ভ্রূণ। হয়ে গেল মেডিক্যাল বর্জ্য! হাতযশ কার বা কাদের?

পুলিশেরই হাতযশ কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে রবিবার হরিদেবপুরের একটি ঘটনায়। শুধু প্রশ্ন নয়, ব্যাগভর্তি ভ্রূণ দিনশেষে কোন মন্ত্রে মেডিক্যাল বর্জ্য হয়ে যেতে পারে, ঘনীভূত হয়েছে সেই রহস্যও।

হরিদেবপুরের একটি ফাঁকা জমি পরিষ্কার করতে গিয়ে কয়েকটি প্লাস্টিকের ব্যাগে ১৪টি মানবভ্রূণ ও নবজাতকের দেহ উদ্ধারের ‘খবর’ শুনে সকালেই পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অকুস্থলে পৌঁছে যান কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমার স্বয়ং। যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) প্রবীণ ত্রিপাঠী, ডিসি (সাউথ-ওয়েস্ট) নীলাঞ্জন বিশ্বাস তো ছিলেনই। প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি এমআর বাঙুর হাসপাতালে পাঠানো হয় ময়না-তদন্তের জন্য।

পুলিশ জানায়, একটি প্রোমোটার সংস্থা হরিদেবপুরের মুচিপাড়ায় ২১৪ নম্বর রাজা রামমোহন রায় রোডের ফাঁকা জমির জঙ্গল সাফাইয়ের সময় ১৪টি মানবভ্রূণ এবং সদ্যোজাত শিশুর দেহ পেয়েছে। বিকেলে সাংবাদিক বৈঠক করে ডিসি নীলাঞ্জনবাবু এক ধাপ এগিয়ে জানান, কয়েকটি ভ্রূণে পচন ধরে গিয়েছে। সন্ধ্যায় লালবাজারের ওসি কন্ট্রোল থেকে পাঠানো রিপোর্টে জানানো হয়, ওই জমি থেকে ১৪টি ‘প্রিম্যাচিওর’ শিশুর দেহ মিলেছে। তার বেশ কয়েকটি ভ্রূণ। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পরে ভ্রূণের কথা জানান মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও।

লালবাজারের কর্তা এবং মহানাগরিকের সেই বক্তব্যের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বয়ান বেমালুম বদলে ফেলল কলকাতা পুলিশ! সন্ধ্যা সওয়া ৭টা নাগাদ ডিসি (সাউথ-ওয়েস্ট) জানান, বাঙুর হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ব্যাগ খুলে কোনও ভ্রূণ বা মানবকোষের সন্ধান পাননি বলে জানিয়েছেন। প্লাস্টিকের ব্যাগে ছিল হাসপাতালের কিছু বর্জ্য ও ড্রাই আইস! একই কথা জানান যুগ্ম কমিশনার তথা গোয়েন্দা-প্রধান প্রবীণ ত্রিপাঠীও।

এক ঘণ্টার ব্যবধানে পুলিশের বয়ানে এমন আকাশ-পাতাল ফারাক ঘটে গেল কোন জাদুমন্ত্রে? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, পুলিশেরও ভুল হয়। তা বলে এমন ভুল? নাকি আদৌ ভুল নয়? রহস্যভেদ হয়নি।

অথচ শুরুতে রহস্য ছিল না বলেই জানাচ্ছেন সাফাই-শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্ট প্রোমোটার সংস্থার ইঞ্জিনিয়ার বাবাই বেরা। বাবাইবাবু বলেন, ‘‘সকালে জঞ্জাল সাফাইয়ের সময় শ্রমিকেরা জমির এক প্রান্তে কিছু প্লাস্টিকের ব্যাগ পড়ে আছে বলে জানিয়ে কাজ করতে অস্বীকার করেন। কেন তাঁরা তা সাফ করতে চাইছেন না, জানতে চাওয়ায় শ্রমিকেরা জানান, ব্যাগে ১৪টি ভ্রূণ আর সদ্যোজাত শিশুর দেহ রয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ডেভেলপারকে ফোন করে সব জানাই।’’

পুলিশি সূত্রের খবর, হরিদেবপুর থানা এলাকার ওই পাঁচিল-ঘেরা জমিতে নির্মাণকাজের তোড়জোড় চলছে। প্রোমোটারের লোকজন এ দিন সকালে জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ পান। উৎস খুঁজতে গিয়ে তাঁরা দেখেন, এক জায়গায় বেশ কয়েকটি প্লাস্টিকের ব্যাগ পড়ে আছে। সেগুলি খুলতেই মানবভ্রূণ এবং নবজাতকদের দেহ বেরিয়ে পড়ে। শ্রমিকেরা খবর দেন ওই জমি দেখভালের দায়িত্বে থাকা ম্যানেজারকে। পরে খবর যায় স্থানীয় ১২২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সোমা চক্রবর্তীর কাছে।

সোমাদেবী খবর দেন হরিদেবপুর থানায় এবং মেয়র শোভনবাবুকে। বিশাল পুলিশবাহিনী দিয়ে জায়গাটি ঘিরে ফেলা হয় এবং পাঁচিল ঘেরা জমির ভিতর থেকে ১৪টি প্লাস্টিকের মোড়ক উদ্ধার করে অ্যাম্বুল্যান্সে করে পাঠানো হয় বাঙুর হাসপাতালে। বিকেল ৪টে নাগাদ কাউন্সিলর, মেয়র, পুলিশ কমিশনার-সহ সকলেই এলাকা ছাড়েন। সেই সময় মেয়র জানান, ১৪টি ভ্রূণ ও নবজাতকের দেহ উদ্ধার করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। সিপি কিছু বলেননি। বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ ডিসি নীলাঞ্জনবাবু সাংবাদিক বৈঠক ডেকে ভ্রূণ ও নবজাতকের দেহগুলি ময়না-তদন্তে পাঠানোর কথা জানান।

এত ভ্রূণ ও শিশুদেহ কোথা থেকে এল, তা জানতে চাওয়া হলে নীলাঞ্জনবাবু জানান, তাঁরা তদন্ত শুরু করেছেন। খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে আশপাশের নার্সিংহোমগুলিতেও। তিনি বলেন, ‘‘সব ভ্রূণ আর নবজাতকের দেহই প্লাস্টিকে মোড়া ছিল। মোড়কগুলি কাদাজলে মাখামাখি হয়ে যাওয়ায় কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ময়না-তদন্ত না-হলে ঠিক করে কিছু বলা যাবে না।’’

অর্থাৎ তখনও পর্যন্ত প্লাস্টিকের ব্যাগে ভ্রূণ এবং নবজাতকদের দেহই ছিল। সেগুলো ওখানে কী ভাবে এল, কে বা কারা ফেলে গেল, সেটা বড় প্রশ্ন নিশ্চয়ই। কিন্তু বৃহত্তর রহস্য শুরু হয় তার পরে, পুলিশ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে বয়ান বদলে ফেলায়। সাংবাদিক বৈঠকের এক ঘণ্টা পরেই ডিসি (সাউথ-ওয়েস্ট) হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে জানান, ‘মোড়কগুলিতে কোনও মানবভ্রূণ মেলেনি। কিছু ড্রাই আইস পাওয়া গিয়েছে!’

এক ঘণ্টার মধ্যে ভ্রূণ ও শিশুদেহ কী ভাবে স্রেফ ড্রাই আইসে পরিণত হয়ে যেতে পারে, স্বয়ং ভানুমতীরও জাদুবিদ্যায় এতটা ব্যুৎপত্তি ছিল কি না— শুরু হয় সেই জল্পনা।

প্রশ্ন উঠছে: যে-ঘটনার পরে খোদ মেয়র এবং গোয়েন্দা-প্রধান জানান যে, ১৪টি ভ্রূণ ও শিশুদেহ পাওয়া গিয়েছে এবং তদন্ত চলছে, সেই ঘটনায় এমন চমকপ্রদ মোড়ের পিছনে লুকিয়ে আছে কোন রহস্য?

প্রশ্ন উঠছে: মেয়র ও পুলিশকর্তা উপযুক্ত তথ্য যাচাই করেই এমন কথা বলেছিলেন তো? যদি তা-ই করে থাকেন, সেই তথ্য আগাপাশতলা বদলে গেল কী করে? আর যদি তথ্য যাচাই না-করেই তাঁরা এমন ঘোষণা করে থাকেন, কেন করলেন?

নীলাঞ্জনবাবুর জবাব, ঘটনাস্থলে মোড়কগুলি খুলেই দেখা হয়নি! হাসপাতালে চিকিৎসকেরা দেখেই জানিয়েছেন, ওগুলিতে কোনও ভ্রূণ বা মানবকোষ নেই। তা হলে তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে ঘোষণা করা হল কেন? ‘‘মোড়কগুলি উপর থেকে দেখে সদ্যোজাতদের দেহ মনে হয়েছিল। আমরা খুলে দেখতে পারিনি। তা হলে সেগুলি নষ্ট হয়ে যেত। তা ছাড়া আমাদের কাছে অভিযোগও ছিল, ওগুলি মানবভ্রূণ এবং সদ্যোজাতের দেহ। তাই প্রাথমিক ভাবে সেটাই বলা হয়েছিল,’’ জবাব নীলাঞ্জনবাবুর।

অন্য বিষয়গুলি:

Embryo Medical Waste Investigation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE