গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
নতুন রং লাগতে চলেছে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবে। রাজনীতির রং বরাবরই ছিল কলকাতার দুর্গোৎসবে, তবে রাজনৈতিক টানাপড়েনটা ছিল না। পরিবর্তনের আগেও ছিল না, পরেও না। কিন্তু বাংলার রাজনৈতিক আকাশে সবুজ রঙের একচ্ছত্র দাপট অনেকখানি মুছে গিয়ে গেরুয়া রং উজ্জ্বল হয়ে উঠতেই সেই টানাপড়েনের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। কলকাতার বেশ কিছু বড় পুজো কমিটির কর্তারা নিঃশব্দে রাজনৈতিক আনুগত্য বদলে ফেলার চেষ্টা শুরু করেছেন। বিজেপি নেতৃত্বও অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন এ বারের আসন্ন দুর্গোৎসবকে।
কলকাতা এবং শহরতলির বিগ বাজেটের দুর্গাপুজোগুলোর প্রায় প্রত্যেকটাই এত দিন তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণে থেকেছে। তৃণমূলের ৮ বছরের শাসনকালে এই কমিটিগুলো তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এমন নয়। বামফ্রন্ট জমানাতেও এই সব পুজো কমিটির অধিকাংশই প্রথমে ছিল কংগ্রেস নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। পরবর্তী কালে সেই নেতাদের অনেকেই তৃণমূলে গিয়েছেন, ফলে পুজোর নিয়ন্ত্রণও তৃণমূলের হাতে গিয়েছে। যেমন বছরের পর বছর ধরে দক্ষিণ কলকাতার একডালিয়া এভারগ্রিন সুব্রত মুখোপাধ্যায়েরই পুজো। আর মধ্য কলকাতার সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার বা উত্তর কলকাতার নলিন সরকার স্ট্রিট যথাক্রমে প্রদীপ ঘোষ ও অতীন ঘোষের পুজো হিসেবেই পরিচিত। সে তাঁরা যে দলেই থাকুন না কেন।
নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ বরং পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজো হিসেবে পরিচিত হয়েছে অপেক্ষাকৃত দেরিতে। কিন্তু সুরুচি সঙ্ঘে অরূপ বিশ্বাস, চেতলা অগ্রণীতে ফিরহাদ হাকিম বা ত্রিধারা সম্মিলনীতে দেবাশিস কুমারদের কর্তৃত্ব আবার বহু দিনের।
দীর্ঘ দিন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থেকেছে বামেরা। সে পর্বে কলকাতা পুরসভার দখলও অনেকটা সময় ধরে বামেদের হাতেই ছিল। তা সত্ত্বেও কলকাতা বা শহরতলির দুর্গোৎসবগুলোর আয়োজনে সক্রিয় ভাবে অংশ নেওয়ার আগ্রহ সিপিএম নেতাদের মধ্যে সে ভাবে দেখা যায়নি। হাতে গোনা কিছু পুজোর নিয়ন্ত্রণ সিপিএমের হাতে ছিল। যেমন সুভাষ চক্রবর্তীর ভাবশিষ্য হওয়ার সুবাদে দক্ষিণ দমদম পুরসভার শ্রীভূমি এলাকার তৎকালীন কাউন্সিলর সুজিত বসুই হয়ে উঠেছিলেন শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের পুজোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আর বিধাননগরের এফডি ব্লকের পুজো খোদ সুভাষ চক্রবর্তীর পুজো হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিল। সুভাষের প্রয়াণের পরে এফডি ব্লকের নিয়ন্ত্রণ তৃণমূলের হাতে চলে গিয়েছে। আর সুজিতও অনেক দিন ধরেই তৃণমূলে, তাই শ্রীভূমি স্পোর্টিঙের নিয়ন্ত্রণও তৃণমূলে।
আরও পডু়ন: ‘সবাই ব্যস্ত, কেউ ভালবাসে না’, ফের কলকাতার নামী স্কুলের শৌচাগারে আত্মহত্যার চেষ্টা ছাত্রীর
তাত্ত্বিক বা আদর্শগত কারণেই পুজো কমিটি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতেন সিপিএম নেতারা। সুভাষ চক্রবর্তী এবং তাঁর অনুগামীরা ছাড়া অন্য কোনও সিপিএম নেতা দলের সে লাইন অগ্রাহ্য করার সাহসও তেমন দেখাতেন না। সুভাষ যে কখনও দলের বাধা পাননি, তা নয়। অনেক বার এ সব বিষয় নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন, ভর্ৎসিতও হয়েছেন। কিন্তু নিজের স্টাইলের রাজনীতি বা জনসংযোগ থেকে তিনি পিছু হঠেননি। সিপিএমের বাকি নেতারা ওই রকম সাহস দেখানোর চেষ্টা করেননি। সুতরাং কংগ্রেস বা তৃণমূল নেতাদের হাত থেকে পুজোর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়ার চেষ্টাও করেননি। ফলে পুজোকে ঘিরে রাজনৈতিক টানাপড়েন সে ভাবে তৈরি হতে দেখা যায়নি।
কিন্তু পরিস্থিতি এ বার বদলাতে শুরু করেছে। তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে এখন যে দল উঠে এসেছে, সেই বিজেপি পুজোআর্চায় অনাগ্রহী নয়। বরং কলকাতার তথা বাংলার দুর্গাপুজো খুব বড় ইস্যু বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্বের কাছেও। মহরম উপলক্ষে দুর্গাপ্রতিমার বিসর্জন স্থগিত রাখার যে নির্দেশ বেশ কয়েক বার জারি করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার, সেই নির্দেশকে সংখ্যালঘু তোষণের খুব বড় নিদর্শন হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন খোদ নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ। এ রাজ্যে একাধিক জনসভায় মোদী-শাহ দুর্গাপ্রতিমার বিসর্জন স্থগিত রাখার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র তোপ দেগেছেন। এ বার জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গোৎসবের আয়োজনটাও করে দেখিয়ে দিতে চাইছে গেরুয়া শিবির।
আরও পড়ুন: বাংলার ‘জিহাদ বাজার’ই এখন টার্গেট, জেএমবি-কে সামনে রেখে লড়াই আইএস-আল কায়দার
বিধাননগরের চারটি বিগ বাজেট পুজো কমিটির মধ্যে একটির নিয়ন্ত্রণ অনেক দিন ধরেই বিজেপির হাতে। এ বার সেখানকার আরও একটি বিগ বাজেট পুজোয় গেরুয়া রং লাগার সম্ভাবনা রয়েছে— সেটি বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্তর পুজো হিসেবে পরিচিত।
কলকাতাতেও বেশ কিছু নামী পুজো কমিটির নিয়ন্ত্রণ এ বার নিজেদের হাতে নিতে সচেষ্ট বিজেপি। উত্তর, মধ্য বা দক্ষিণ— কলকাতার সব অংশেই পুজো কমিটিগুলোর সঙ্গে বিজেপি নেতৃত্বের কথা চলছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খাসতালুক দক্ষিণ কলকাতা থেকেই সাড়া সবচেয়ে ভাল বলে বিজেপি সূত্রে জানা যাচ্ছে।
কালীঘাট এলাকার সবচেয়ে বড় বাজেটের পুজো কমিটিই এ বার বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে খবর। রাসবিহারী এলাকার খুব নামী একটি পুজো কমিটির সঙ্গেও বিজেপি নেতৃত্বের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। দুটো পুজোই প্রায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের পাড়ার।
ওই সব পুজো কমিটির সঙ্গে যে বিজেপি নেতৃত্বের কথা শুরু হয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু। তাঁর কথায়, ‘‘শুধু ওই দুটো পুজো কমিটি নয়, কলকাতার নামী পুজো কমিটিগুলোর মধ্যে ১০ থেকে ১৫টা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমরাও পাশে থাকার চেষ্টা করছি। ওঁরা ঠিক কী চান, কী ধরনের সাহায্য চান, তা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব কি না, আমরা তা গুরুত্ব দিয়েই ভাবছি।’’
প্রশ্ন হল, পুজো কমিটিগুলো কেন ঝুঁকতে চাইছে বিজেপির দিকে? কী ধরনের সাহায্যই বা বিজেপির থেকে আশা করছে তারা? পুজো আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, আয়কর বিভাগের ভয়ে বিজেপির দিকে ঝুঁকতে চাইছে পুজো কমিটিগুলো। গত বছর কলকাতার ৪০টা পুজো কমিটিকে নোটিস পাঠিয়েছিল আয়কর বিভাগ। পুজো আয়োজনে আয়-ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব দিতে বলা হয়েছিল। তা নিয়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল আয়োজকদের মধ্যে। জমাখরচের কাগজপত্র বগলদাবা করে অনেক পুজো আয়োজককেই একাধিক বার ছুটতে হয়েছিল আয়কর দফতরে। তৃণমূল নেতাদের পৃষ্ঠপোষণায় থাকলে এ বারও বিজেপির অঙ্গুলিহেলনে ওই রকম পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং তা এড়াতেই বড় বাজেটের কিছু কিছু পুজো কমিটি বিজেপির আশ্রয়ে যেতে চাইছে— তৃণমূলের একাংশের ব্যাখ্যা এই রকমই।
বিজেপি অবশ্য সে তত্ত্ব নস্যাৎ করছে। সায়ন্তনের কথায়, ‘‘ভয় দেখিয়েই যদি পুজোর দখল নেওয়ার হত, তা হলে কলকাতার সব বড় পুজোই দখল করে নিতে পারতাম। সে রকম কোনও উদ্দেশ্য আমাদের নেই। আমরা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে কোনও পুজো কমিটির সঙ্গে কথা বলতেও যাইনি। যাঁরা নিজে থেকে এসেছেন, যোগাযোগ করেছেন, সাহায্য চেয়েছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’’
সায়ন্তন যা-ই বলুন, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার বিষয়টি যে পুজো উদ্যোক্তাদের মাথায় ঘুরছে, তা সর্বৈব মিথ্যা নয়। তবে তার সঙ্গে আর্থিক ভাবে কিছুটা সমর্থন পাওয়ার চেষ্টাও আয়োজকরা চালাচ্ছেন। রাজনীতির হাওয়া বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজনীয়তার কথাও কেউ কেউ ভাবছেন। সব মিলিয়েই কলকাতার বেশ কিছু নামী পুজোর রং সবুজ থেকে গেরুয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
উল্টো দিকে বিজেপি-ও খুব আগ্রহী কলকাতার তথা বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসবে নিজেদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি সুনিশ্চিত করতে। নামী বা বিগ বাজেট পুজোগুলোয় সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের অংশগ্রহণ থাকে খুব বড় মাত্রায়। তাই কমিটির নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকলে জনসংযোগের প্রশস্ত সুযোগ তৈরি হয়। আর এই পুজোগুলো গত এক দশকে যে ভাবে প্রায় সারা বছরের ইভেন্টে পরিণত হয়েছে, তাতে পুজো আয়োজনের মাধ্যমে এলাকায় এলাকায় প্রভাবও বাড়ানো যায় খুব দ্রুত।
আগামী বছর কলকাতা পুরসভার নির্বাচন। সুতরাং এ বারের দুর্গোৎসব ঘিরে বিজেপি আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠতে চাইবে, এমনটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া বিজেপি-কে যে ভাবে বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা তৃণমূল করে চলেছে, বিজেপি নেতৃত্ব তার জবাব দিতেও আগ্রহী। তার জন্য দুর্গাপুজোর চেয়ে ভাল প্ল্যাটফর্ম আর কী-ই বা হতে পারে?
সুতরাং এ বারের দুর্গোৎসবে কলকাতার বেশ কয়েকটা নামী পুজোর উদ্বোধক বদলে যেতে পারে। দিলীপ ঘোষ বা মুকুল রায় তো বটেই, জে পি নাড্ডা বা অমিত শাহকেও কাঁচি হাতে নিয়ে ফিতের সামনে দাঁড়াতে দেখা যেতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy