Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

অনিয়মের হাম্প, প্রাণ হাতে নিয়েই সওয়ার যাত্রীরা, জানেই না প্রশাসন

হাম্পটির উচ্চতা ছ’ইঞ্চিরও বেশি! যেখানে হাম্পের সর্বোচ্চ উচ্চতা চার ইঞ্চি হওয়া বাঞ্ছনীয়। হাম্পটি কারা বানিয়েছিলেন? উত্তর আজও মেলেনি।

সঙ্কট: হাম্পের উচ্চতা এ ভাবেই ডাকছে বিপদ। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

সঙ্কট: হাম্পের উচ্চতা এ ভাবেই ডাকছে বিপদ। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৮ ০২:৩৬
Share: Save:

বর্ষার রাত। স্ত্রীকে নিয়ে গৌরীবাড়ির গলিপথ দিয়ে মোটরবাইকে যাচ্ছিলেন ক্যানাল ইস্ট রোডের বাসিন্দা বিপিন সাঁতরা। হঠাৎ বাইকের গতি কমিয়ে আনতে হয় তাঁকে। সামনেই রাস্তায় পাহা়ড়-প্রমাণ ‘স্পিড ব্রেকার’ (হাম্প)। তবে গতি কমিয়েও নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়নি। ফলে রাস্তায় পড়ে যান তাঁরা। স্ত্রী অক্ষত থাকলেও কোমরে গুরুতর চোট এবং শিরদাঁড়া ভেঙে গত এক বছর ধরে শয্যাশায়ী বিপিন।

সে সময়ে তদন্তে নেমে উল্টোডাঙা ট্র্যাফিক গার্ড ওই হাম্প ভেঙে দেয়। দেখা যায়, হাম্পটির উচ্চতা ছ’ইঞ্চিরও বেশি! যেখানে হাম্পের সর্বোচ্চ উচ্চতা চার ইঞ্চি হওয়া বাঞ্ছনীয়। হাম্পটি কারা বানিয়েছিলেন? উত্তর আজও মেলেনি।

শহরজুড়ে ‘ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেস’-এর নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গজিয়ে ওঠা একাধিক হাম্প নিয়ে এ ভাবেই কোনও উত্তর মেলে না। কয়েকটি হাম্পের উচ্চতা এমনই, গাড়ি আটকে যায় তাতে। গাড়িচালকদের বড় একটি অংশের অভিযোগ, হাম্প তৈরি হলেও নিয়ম মেনে তাতে রং করা থাকে না। ফলে দূর থেকে বোঝাই যায় না, রাস্তার কোন অংশে হাম্প রয়েছে এবং তার উচ্চতা কত? কার্যত অন্ধকারে প্রাণ হাতে নিয়েই সওয়ার হচ্ছেন যাত্রীরা।

কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের একটি নথিতেই স্পষ্ট, গত এক বছরে ৫০০-র বেশি পথ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী উঁচু হাম্প। গত ছ’মাসে শুধুমাত্র হাম্পের কারণেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের। সরকারি নথি এ কথা বললেও হাম্প-বিপত্তিতে দুর্ঘটনার সংখ্যা আসলে আরও বেশি বলেই মনে করে প্রশাসনের একটা বড় অংশ!

সড়ক উন্নয়নের লক্ষ্যে হাইওয়ে ইঞ্জিনিয়রদের নিয়ে তৈরি কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেস’-এর নির্দেশিকায় ছিল, হাম্প তৈরি করা যায় কোন কোন ক্ষেত্রে। তবে সব নির্দেশিকা শুধু খাতায়-কলমেই রয়ে গিয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ— শহর কলকাতার বাস্তব চিত্রটা একেবারে আলাদা। যত্রতত্র হাম্প তৈরি করা হয়েছে, স্থানীয়দের ইচ্ছেতেই। এমনকি অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে হাম্পের উচ্চতাও ঠিক করে দিয়েছেন স্থানীয়েরাই!

দক্ষিণ কলকাতার একডালিয়ায় রাজ্যের এক প্রথম সারির নেতার বাড়ির সামনে হাম্পের উচ্চতা এমনই, ডান দিকে বা বাঁ দিকে না বেঁকিয়ে সোজাসুজি সেখান দিয়ে গাড়ি পারই করা যায় না। বেহালা, মুদিয়ালি এবং কর্নফিল্ড রোডের বেশ কয়েকটি হাম্প মাটি থেকে খাড়া হয়ে মাথা তুলে রয়েছে। তাতে গাড়ির চাকা ওঠার এবং নামার ব্যবস্থা একেবারেই মসৃণ নয়। উত্তরের শোভাবাজার, পাইকপাড়া, বেলগাছিয়া, মিল্ক কলোনির একাধিক রাস্তারও একই অবস্থা। শ্যামবাজারের প্রাণকৃষ্ণ মুখার্জি রোডের হাম্পের অধিক উচ্চতার জন্য স্থানীয়দের যুক্তি, এ পথে লরি যায়। তাই উঁচু। কিন্তু এত উঁচু করলে অন্য গা়ড়ি যাবে কী করে? ওই পথ তো শুধু লরির জন্য নয়! মেলেনি উত্তর।

শহরের হাম্প-চিত্র নিয়ে প্রশাসনও এক প্রকার নিরুত্তর। রাজধানী শহর দিল্লিতে হাম্প তৈরির আগে ডেপুটি কমিশনার অব পুলিশের (ট্র্যাফিক) দফতরে চিঠি দিয়ে অনুমতি নিতে হয়। কলকাতায় তা হয় না কেন? কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের এক কর্তা বললেন, ‘‘পুরসভা তো নিজেরাই সব করে ফেলে। আমাদের কিছু জানায় না।’’ তবে কি যথেষ্ট সমন্বয়ের অভাব রয়েছে? তার জন্যই হচ্ছে সমস্যা? কলকাতা পুলিশের ডিসি (ট্র্যাফিক) সুমিত কুমার বললেন, ‘‘সমস্যা মেটাতে আমরা নিজেরাই বেআইনি হাম্প ভেঙে দিচ্ছি। প্রয়োজনে প্লাস্টিকের হাম্প বসাচ্ছি। পুরসভার সঙ্গে আরও আলোচনা প্রয়োজন।’’ সমন্বয়ের অভাবের কথা মানছেন মেয়র পারিষদ (রাস্তা) রতন দে-ও। তিনি বলেন, ‘‘আমি কী করব? স্থানীয় ভাবেই হাম্প বসে যাচ্ছে। অনেক কিছুই আমার কাছে আসে না।’’

পুলিশ-প্রশাসনকে অন্ধকারে রেখে এ ভাবে হাম্প বসাচ্ছেন কারা? তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? উত্তর নেই কোনও পক্ষেরই!

অন্য বিষয়গুলি:

Hump Speed Breaker Accident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE