নতুন দেশে এসে সাহেব ভাষা বুঝতে পারছেন না। খানসামার কাছে সমস্যার কথা বলতেই হাজির সমাধান: মুনশি। তিনিই এদেশীয় ভাষা শেখাবেন সাহেবকে। মুনশি আরবি ফারসি ইংরেজি ও বাংলা জানেন; কথা বলে সন্তুষ্ট সাহেব তাঁকে বহাল করে বললেন, “তুমি আমার চাকর থাকিয়া আমাকে শিক্ষা করাইবা।” উনিশ শতকের প্রথম দিকে এ ভাবেই সাহেবদের ‘বাঙ্গালি কথা ও কার্য্য কর্ম্মের লেখা পড়া’ শেখার শুভারম্ভের কথা জানা যায় উইলিয়াম কেরির কথোপকথন থেকে। মুনশি রেখে ভাষা শেখার ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হলে। সেখানে বাংলা শেখানোর দায়িত্ব পান কেরি-সহ মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার, রামনাথ বাচস্পতির মতো পণ্ডিতরা। তবে শিক্ষককে যোগ্য সম্মান দিতে সাহেবরা প্রায়ই ভুলে যেতেন। পড়ায় ভুল ধরানোয় কলেজের বাংলা শিক্ষক আনন্দ চন্দ্র শর্মাকে কেনেডি নামে এক সাহেব চাবুক দিয়ে আঘাত করে।
সিভিলিয়ানরা ভারতে এলে তাঁদের কয়েক মাস কলকাতায় থেকে ভাষা শিখতে হত। এক-এক জন মুনশির তত্ত্বাবধানে তিন-চার জন সাহেব শিখতেন, বেতন ব্যক্তিগত ভাবে দিতে হত ‘ছাত্র’দেরই। এ ব্যবস্থা খুব যে কার্যকর, সাহেবরাও তা মনে করতেন না। সিভিলিয়ান জন বিমস স্মৃতিকথায় বলেন, নেটিভদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে আরও ভাল ভাবে দেশীয় ভাষা রপ্ত করা যায়। পরে এদেশীয় ভাষা শেখার একটি বইও লেখেন তিনি।
সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের প্রভাবে সাধুভাষা-ঘেঁষা বাংলায় অভ্যস্ত হচ্ছিলেন সাহেবরা, যার উদাহরণ মেলে বঙ্কিমচন্দ্রের মীনওয়েল সাহেবের মুখে। দুর্ভিক্ষের খোঁজখবর নিতে সাহেব এক চাষিকে জিজ্ঞেস করেছিল, “টোমাডের গ্ড়ামে ডুড়বেক্কা অঢিক কিম্বা অল্প আছে?” প্রশ্নের মানে বুঝতে না পারায় ভুল উত্তর দেন কৃষকটি। আর তা থেকেই শুরু এক ভ্রান্তিবিলাস।
ঔপনিবেশিক আমলের সাহেবদের মধ্যে বাংলা শেখার সফল উদাহরণ গেরাসিম লেবেদেফ। তাঁর ভাষা-শিক্ষক গোলোকনাথ দাস দক্ষিণা নিতেন সাহেবের থেকে পাশ্চাত্যসঙ্গীত শিখে! তবে বাংলা শেখানোর আগে গোলোেথ লেবেদেফকে ভাল করে সংস্কৃত শেখান। লেবেদেফ পরে হিন্দুস্থানি শিক্ষার বই লিখেছিলেন। বৃহত্তর ভারতে কাজের ভাষা হিসেবে ফারসি ও হিন্দুস্থানির চাহিদা সাহেবদের মধ্যে বেশি থাকত। তাই প্রচুর হিন্দুস্থানি শব্দ ঢুকে পড়ে এক ‘খিচুড়ি ভাষা’ তৈরি হল। দুই ভাষা-সংস্কৃতির অনিবার্য সংঘর্ষে এদেশীয়দের মুখের ইংরেজিকে সাহেবরা ‘বাবু ইংলিশ’ বলে ঠাট্টা করলেন, এদেশীয়রাও সাহেবদের বাংলাকে বললেন ‘সাহেবি বাংলা’। ‘রাজা বিক্রমাদিত্যের দুই মহিষী ছিলেন’, সাহেবের ইংরেজি অনুবাদে ‘কিং বিক্রমাদিত্য হ্যাড টু শি-বাফেলোজ়’ হয়ে যাওয়ার গল্প ঘুরত বাঙালিপাড়ার আড্ডায়।
এ-হেন পরিস্থিতিতে সমন্বয়ের কাজটি করেন মহিলারা। জোব চার্নক থেকে ডি এল রিচার্ডসন পর্যন্ত অনেক সাহেবের ঘরনি হয়ে এসেছিলেন বাঙালি মেয়েরা; সাহেবদের মুখে পান, হাতে হুঁকো আর তালপাতার পাখা ধরিয়ে, উৎসব-পার্বণে যুক্ত করে তাঁরা সাংস্কৃতিক সমন্বয় গড়েন। সেই অবদান নিয়ে তেমন আলোচনা কই? ছবিতে সাহেব ও তাঁর মুনশি, ১৮৫৮ সালের বই থেকে।
জীবনমুখী শিল্পী
ভারতীয় দর্শক যখন পর্দায় ক্রমাগত দেখে চলেছেন স্টুডিয়োর কৃত্রিম চিত্র-পট, তেমনই এক সময়ে বংশী চন্দ্রগুপ্ত (ছবি) ফুটিয়ে তোলেন বাস্তবধর্মী বিশ্বাসযোগ্য এক জগৎ, যেন জীবনটাই। ভারতীয় ছবিতে দৃশ্যপট রচনায় শুরু হল নবপ্রবাহ। সত্যজিৎ রায় সুব্রত মিত্র দুলাল দত্তের সঙ্গে মিলিত ভাবে কাজ; একে একে মৃণাল সেন তরুণ মজুমদার, হিন্দি ছবিতে রাজেন্দ্র ভাটিয়া বাসু চট্টোপাধ্যায় অবতার কউল রবীন্দ্র ধর্মরাজ শ্যাম বেনেগাল অপর্ণা সেন প্রমুখের সঙ্গেও: নিজেও পরিচালনা করেছেন কয়েকটি তথ্যচিত্র। শতবর্ষী (জন্ম ১৯২৪) শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন এমন বিশিষ্টজনের স্মৃতিচারণে ঋদ্ধ তথ্যচিত্র বংশী চন্দ্রগুপ্ত তৈরি করেছেন জীবনস্মৃতি আর্কাইভ-এর কর্ণধার অরিন্দম সাহা সরদার; তাঁকে নিয়ে গড়েছেন আর্কাইভও। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি উত্তরপাড়া সিনে ক্লাবের উদ্যোগে দেখানো হল ছবিটি। সঙ্গে ছিল আলোচনা, রবীন্দ্র ধর্মরাজের ছবি চক্র-এর প্রদর্শনও।
ভাষার জন্য
ক্যালন্ডারের পাতায় চলে গেল আরও একটি একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যে ভাষা ও তাকে ঘিরে আন্দোলনের সূত্রে পৃথিবী পেল আপন মাতৃভাষাকে বছরভর চর্চার পাশাপাশি এক বিশেষ দিনের মোড়কে উদ্যাপনের অবকাশ, সেই বাংলা ভাষা কেমন আছে এই ২০২৪-এ? আজকের বাঙালির কাছে কী তার মর্যাদা, তাকে ঘিরে প্রত্যাশাই বা কতটুকু, করণীয় কী কী— এই সব প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ সামনে রেখে গত ২১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হল-এ হয়ে গেল আন্তর্জাতিক সেমিনার। একত্র উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঐকতান গবেষণাপত্র, আমেরিকার একুশে চেতনা পরিষদ ও সর্বভারতীয় বাংলাভাষা মঞ্চ। অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য ও স্বরোচিষ সরকার ছাড়াও বললেন কলকাতা ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা।
নতুন করে
ঔপনিবেশিক শাসনে ব্রিটিশ সরকারের অনুগামী মুৎসুদ্দিদের দাপট, বাবু-শ্রেণির ক্ষয়িষ্ণু জীবনযাপন, পর্যুদস্ত অর্থনীতি, নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন— ধূসর মানচিত্র ফুটে ওঠে উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার নাটকে, প্রথম মঞ্চায়ন সত্তর দশকের শুরুতে। ভারতের ইতিহাসে সে এক অগ্নিগর্ভ সময়, কয়েক বছর পরেই জরুরি অবস্থা। প্রতিস্পর্ধী সংস্কৃতির প্রয়োজনেই এখন নতুন করে অভিনীত হতে চলেছে নাটকটি, মধুসূদন মঞ্চে ২ মার্চ দুপুর আড়াইটা ও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। ‘মুখোমুখি’ নাট্যগোষ্ঠী শুধু এই নতুন প্রযোজনাটিই নয়, এ নাটকের নির্দেশক সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত কিছু নাটক ও চলচ্চিত্রের উৎসবও আয়োজন করেছে: ‘মঞ্চ চিত্রের সুমন’। ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চ অ্যাকাডেমি, মধুসূদন ও শিশির মঞ্চে মেফিস্টো, আজকের সাজাহান, হারবার্ট, নজরবন্দ-এর মতো নাটক ও ছবি দেখতে পাবেন দর্শক।
শহরের ঐতিহ্য
পরবর্তী প্রজন্মকে তাদের উত্তরাধিকারের সঙ্গে পরিচয় করানো ঐতিহ্য সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রাচীন জিনিসপত্র আজকের নাগরিকদের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি, তার নথি তৈরির কাজটিও জরুরি। গত কয়েক বছর ধরে কলকাতাপ্রেমী বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষের ঐতিহ্য সংক্রান্ত লেখালিখি নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকা কলকাতা কথকতা, তার সাম্প্রতিক সংখ্যায় উঠে এসেছে নানা বিষয়: এ বছর গণপরিবহণ হিসেবে কলকাতায় বাস চালু হওয়ার একশো বছর পূর্তিতে বাস পরিষেবার ইতিহাস, শহরের সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমাহল, কলকাতার প্রথম আর্ট গ্যালারি, কোম্পানি আমলের চিকিৎসা, বনেদি পরিবারগুলির পারিবারিক ঝুলন উৎসব ইত্যাদি।
খেলার ছবি
ছয় দেশ, সাত ভাষা, কুড়িটি ছবি। কলকাতায় ফিরে এসেছে ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া, দ্বিতীয় বছরের উৎসব উদ্বোধন আজ সন্ধে ৬টায় আইসিসিআর-এ। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া-র (এফএফএসআই) পূর্বাঞ্চল শাখার নিবেদনে গত বছরই এই ফিল্মোৎসব নজর কেড়েছিল, সিনেমা আর খেলা দুই-ই তো এ শহরের খুব প্রিয়! আগামী কাল থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত নন্দন-৩’এ দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে শুরু: চ্যারিয়টস অব ফায়ার, দ্য স্টার্ট, ওয়ান ইন আ মিলিয়ন, স্ট্রংগার, লিটল জায়ান্টস, কোচ কার্টার, আঙ্কল ড্রিউ, দ্য ব্লু গার্ল, ভেনাস অ্যান্ড সেরেনা। কোনি, কুসুমিতার গপ্পো-র মতো বাংলা ছবির পাশে আয়রন উওমেন অব মণিপুর, সচিন লাইভ ফ্রম পুণে, অ্যান্ড্রো ড্রিমস, লাদাখ ৪৭০-এর মতো অন্য ভারতীয় ভাষার ছবিও।
স্মরণার্ঘ্য
ছবির জগৎ এক নিস্তব্ধতার জগৎ, এগজ়িবিশনে টাঙানো ছবি কখনও বলে না: আমাকে দেখে যাও। অথচ তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো দর্শককে সে নাড়িয়ে দিতে পারে, নিয়ে যেতে পারে অন্য জগতে— এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কে জি সুব্রহ্মণ্যন। ভারতীয় চিত্রকলার অন্যতম এই পথিকৃৎ, বাংলার আপনজন ‘মানিদা’র জন্মশতবর্ষ এ বছর। তারই উদ্যাপন হয়ে গেল গত ১৩ ফেব্রুয়ারি গ্যালারি চারুবাসনার উপেন্দ্রকিশোর সভাঘরে। শিল্পীর এক ভিডিয়ো-সাক্ষাৎকারের রেকর্ডিং দেখানো হল, ২০১৬-র ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে যেটি নিয়েছিলেন অরিজিৎ মৈত্র। স্মৃতিচারণে তাঁর প্রিয় মানিদাকে শ্রদ্ধা জানান যোগেন চৌধুরী, শিল্পীকে নিয়ে বললেন নন্দিনী ঘোষ এবং আর শিবকুমার। ছবিতে শান্তিনিকেতনের বাড়িতে কর্মমগ্ন কে জি সুব্রহ্মণ্যন।
দুশো বছরে
১৮২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় সংস্কৃত কলেজের। উনিশ শতকের কলকাতায় প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার লক্ষ্যে তৈরি এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সংস্কৃত চর্চায় অপরিসীম, অন্য দিকে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে সে শিক্ষা সংস্কারের অন্যতম কেন্দ্র। প্রাচ্যবিদ্যার পাশাপাশি আধুনিক সাহিত্য ও দর্শন শিক্ষারও পীঠ। তারানাথ তর্কবাচস্পতি মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নের মতো সংস্কৃতজ্ঞের পাশাপাশি পালি জাতকের প্রখ্যাত অনুবাদক ই বি কাওয়েল, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস-লেখক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, চর্যাপদ-এর আবিষ্কর্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আধুনিক ভারতের প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদক মধুসূদন গুপ্ত, ইতিহাসবিদ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ যুক্ত ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। দু’শো বছরের যাত্রায় প্রতিষ্ঠান এখন সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। আগামী কাল সকাল ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাসাগর হল-এ হবে দ্বিশতবার্ষিকী উদ্যাপন, আচার্য, উপাচার্য ছাড়াও বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে। থাকবে প্রদর্শনী ও তথ্যচিত্র প্রদর্শন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলকাতা ও নবদ্বীপ ক্যাম্পাসে বছরভর নানা অনুষ্ঠান।
পুজো-প্রেম
‘ভালবাসার ধর্মই প্রতিধ্বনিত হোক উচ্চারণে’— কিছু দিন আগে বড় হরফে এমনই লেখা হোর্ডিংয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল কলকাতাময়। সরস্বতী পুজো এবং ভ্যালেন্টাইন দিনের মণিকাঞ্চন যোগে এ হেন আর্তি মেলে ধরল নামী সর্বজনীন পুজো টালা প্রত্যয়। বাঙালির কাছে প্রেম-পুজো বরাবরই একাকার। দেশ জুড়ে ধর্মকর্মে আবার ভালবাসার অভাবটাই প্রকট। সরস্বতী পুজোয় ভালবাসার ডাকাডাকিতে তাই গভীরতর অর্থেরও ছোঁয়া। সরস্বতী ঠাকুর দেখতে অভাবনীয় ভিড়ে হতচকিত হলেন উদ্যোক্তারা। টালা পার্কের মণ্ডপে বসেছিল ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর, ‘মিউজ়িক ইন আ পার্ক’ শিরোনামে: তবলা, সরোদ, সন্তুরের সঙ্গে মৃদঙ্গ, ঘটমের সংলাপ। ছিলেন তন্ময় বসু, বিক্রম ঘোষ প্রমুখ, এর পরে পাড়াসুদ্ধ নৈশভোজের আয়োজন। সুর, তাল লয় থেকে সুস্বাদের সমে স্থিত চিরন্তন বাণীবন্দনার আমেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy