Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড

মাথা তুলছে বহুতল, দ্রুত হারাচ্ছে সবুজ

দেখতে দেখতে প্রায় পঁয়ত্রিশটা বছর কেটে গেল এই পাড়ায়। আমাদের পাড়াটা বাবা বেশ অভিজাত! নাম— বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। আমার সঙ্গে এই পাড়ার বাসিন্দা কারা জানেন? ছিলেন সুচিত্রা সেন। আছেন সুমিত্রা সেন, ইন্দ্রাণী সেন, বরুণ চন্দ, সৌমেন্দু রায়, যোগেশ দত্ত। আর কী চাই? একেবারে চাঁদের হাট।

শ্রাবণী সেন
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৫১
Share: Save:

দেখতে দেখতে প্রায় পঁয়ত্রিশটা বছর কেটে গেল এই পাড়ায়। আমাদের পাড়াটা বাবা বেশ অভিজাত! নাম— বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। আমার সঙ্গে এই পাড়ার বাসিন্দা কারা জানেন? ছিলেন সুচিত্রা সেন। আছেন সুমিত্রা সেন, ইন্দ্রাণী সেন, বরুণ চন্দ, সৌমেন্দু রায়, যোগেশ দত্ত। আর কী চাই? একেবারে চাঁদের হাট।

বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সবথেকে পুরনো হাইরাইজ ‘সপ্তপর্ণী’তে আমার বাস। যখন এসেছিলাম পড়তাম পাঠভবনে, ক্লাস ফাইভে। ‘সপ্তপর্ণী’ দিল আমার প্রথম মঞ্চ। আমার নাটক করা, পুজোর সম্পাদক হওয়া, ঢাক বাজানো, আমার প্রথম গাড়ি চালানোর শিক্ষা— সবই দিয়েছে এই পাড়া।

পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পড়তে ঢুকলাম বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে। আমার ঘর থেকে আমার ক্লাসরুম যে দেখা যায়! কোথাও বেশি ক্ষণ থাকারও উপায় নেই। আর বাবার কাছে টাকা চাইলেই রোজ পেতাম দুই দুই চার টাকা। যাতায়াতের ভাড়া নেই। এক টাকায় তখন দশটা ফুচকা। আর বেশি কী চাই? কী কাণ্ড!

সেন্ট লরেন্স স্কুল আমাদের পাড়ায়। কত কৃতী ছাত্র যে এই স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়েছে তা বলাই বাহুল্য। পাশেই ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ, যেখানে আমরা এখনও ভোট দিতে যাই। এবং সুচিত্রা সেনকে এখানেই সর্বশেষ দেখেছিলেন তাঁর ভক্তরা।

মর্নিং ওয়াকের আদর্শ জায়গা আমাদের এই পাড়া। পাশে ম্যাডক্স স্কোয়ার আছে। পুরো রাস্তা আছে, যেখানে খুশি হাঁটো। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাকে এক দিনের জন্যও হাঁটাতে পারেনি। এটাই দুঃখের। আসলে হাঁটলে না কি শুনেছি শরীর ঝরঝরে হয়। আমার আবার উল্টো, ম্যাজম্যাজ করে! তাই আমার হাঁটাও আর হল না, সঙ্গে রোগা হওয়াও কপালে নেই। দেখি পরের জন্মে যদি ডানা কাটা পরি হওয়া যায়।

আমরা প্রথম যখন আসি এই পাড়ায় তখন প্রচুর বাংলো বাড়ি ছিল। সকাল বেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় পাশ দিয়ে যেতাম আর ভাবতাম বড় হয়ে কোনও বাড়ির ছেলের সঙ্গে গাঁট ছড়া বাঁধব! ও মা! প্রায় বুড়ো হতে চললাম। বাড়িগুলো ভেঙে সব হাইরাইজ হচ্ছে। কিছুটা হলেও এই পাড়ার চেহারাটা পাল্টে যাচ্ছে। গাছ কাটা হচ্ছে প্রচুর, সেটা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। প্রচুর গাছ ছিল আমাদের পাড়ায়। তাই বেশ ঠান্ডাও লাগত।

এখানে আছে বিখ্যাত একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁ। আমাদের পাড়ার গর্ব। কে না আসেন এখানে খেতে! এমনকী অভিনেত্রী রানি মুখোপাধ্যায়ও গভীর রাতে লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে ডিনার করতে ভালবাসেন। খাবারের বিষয় (আমার সব থেকে প্রিয় বিষয়) যখন উঠলই তখন দেওদার স্ট্রিটের মোড়ের মাথার হালদার সুইটসের কথা কেমন করে ভুলি। সেই মিষ্টি লাল দইয়ের মাথা যে এক বার খেয়েছে— সে মরেছে। আছে ক্যাফে কফি ডে, মামা মিয়া। সবই ‘স্বাস্থ্য বাড়ানো’র পক্ষে যথেষ্ট।

আমাদের পাড়ার নবতম সংযোজন একটি বিখ্যাত শাড়ির দোকান। কলকাতায় এই প্রথম তাদের শাখা খুলেছে। শুনেছি, এক লাখ টাকা দামের শাড়িও আছে। এক বার চোখের দেখা দেখতে চাই। আমাদের ‘সপ্তপর্ণী’র দিদি, মামি, কাকি সবাই রোজ এক বার কোনও না কোনও ছুতোয় সেই দোকানে ঢুকে পড়ছেন। কত যে ফোন আসছে এই দোকানটিকে নিয়ে। ঠিক কোন জায়গাটায় দোকানটি তা নিয়েই যত জিজ্ঞাসা। দোকানটির জন্যও আমি ফেমাস হয়ে যাচ্ছি।

এই আমাদের দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পাড়া। অনেক উন্নয়ন হচ্ছে এই পাড়ার। তার মাঝে হার ছিনতাইও হচ্ছে। তবে ছোটবেলায় যাঁদের হাত ধরে বড় হয়েছি, তাঁদের কয়েক জনকে হারিয়েছি। তাঁদের খুব মিস করি। আর যাঁরা আছেন, তাঁদের হারাবার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকি। তাঁদের ভালবাসা, স্নেহ, মূল্যবোধ নিয়েই তো আমরা বড় হয়েছি। সেগুলো কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও এ সব নিয়ে আমরা বেশ আছি এ পাড়ায়। ভাল-মন্দ মিশিয়ে।

লেখক বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE