লালবাজারে ঢোকার সময় গোপাল। —নিজস্ব চিত্র।
রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ খবর এল লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের চারতলায়— ‘‘অতিথি হোটেলে আসছে!’’ সেই খবর পাওয়ার পরেই তেঘরিয়ার একটি শপিং মল সংলগ্ন হোটেলের চারপাশ ঘিরে ফেলল সাদা পোশাকের পুলিশ। লালবাজার থেকেও রওনা হলেন গোয়েন্দাদের একটি দল।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ৫। তেঘরিয়ার ওই হোটেলে পৌঁছল হলুদ টি-শার্ট এবং খয়েরি ট্রাউজার্স পরা এক ব্যক্তি। পিঠে কালো রঙের ব্যাগ। হোটেলের রেজিস্টারে নাম-ধাম লিখে চারতলার ৩০৪ নম্বর বিলাসবহুল ঘরে ঢুকে গেল সে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওই হোটেলে পৌঁছে গেলেন লালবাজারের হোমিসাইড ও গুন্ডাদমন শাখার একদল অফিসার। হোটেলের ম্যানেজারকে নিয়ে সোজা চারতলায় উঠে গেলেন তাঁরা। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়েই দরজা খুলে দিল ‘অতিথি’। দরজার সামান্য ফাঁকটুকু গলে ভিতরে ঢুকে পড়লেন অফিসারেরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ‘অতিথি’ টের পেল, সে চলে গিয়েছে পুলিশের কব্জায়!
অতিথির নাম গোপাল তিওয়ারি। কলকাতায় পুরভোটের বিকেলে গিরিশ পার্কের সিংহীবাগানে কলকাতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলকে গুলি করার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গত ৩৯ দিন ধরে যে পালিয়ে বেড়িয়েছে।
গোয়েন্দাদের একাংশ বলছেন, গিরিশ পার্কের ঘটনার পরেই গোপাল শহর ছেড়ে পালিয়েছিল। যদিও অভিযোগ, পুলিশেরই উঁচুতলার একাংশ তাকে সে দিন পালাতে দিয়েছিল। এর কারণ, রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে গোপালের ঘনিষ্ঠতা। গোপাল ফেরার হওয়ার পর তৃণমূলের এক বিধায়ক ও এক মন্ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে তার ছবি প্রকাশ্যে এসেছিল। সাম্প্রতিক অতীতে পুলিশ নিগ্রহের বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গিয়েছে, শাসক দলের সঙ্গে অভিযুক্তের বিন্দুমাত্র সান্নিধ্য থাকলেই হাত গুটিয়ে থেকেছে লালবাজার। অনেকের মতে, গোপালের পাশ থেকে ইদানীং সরে গিয়েছিলেন তার রাজনৈতিক মদতদাতারা। কারণ গোপালের কীর্তিতে তাঁরাই ক্রমশ বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছিলেন। কাজেই গোপালের মাথায় আগের মতো ‘দাদাদের’ হাত থাকলে তাকে আদৌ ধরা যেত কি না, সেই প্রশ্ন কিন্তু উঠেছে। এমনকী পুলিশের অনেকেই বলছেন, গোপালকে আত্মসমর্পণ করানোর ব্যাপারে রাজনৈতিক চাপ ছিল। কলকাতা ছেড়ে পালানোর পর গোপাল এ বার একাধিক রাজ্য ঘুরেছে। তার পরেও তার কলকাতায় ফিরে আসাকে কার্যত আত্মসমর্পণ বলেই মনে করছেন লালবাজারের একাংশ।
যদিও এক গোয়েন্দাকর্তা এ দিন বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতেই গোপাল তিওয়ারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ তাঁদের বক্তব্য, গোপালের বেশির ভাগ শাগরেদই পুলিশের নাগাল এড়াতে পারেনি। গোপালের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নজর রাখছিলেন গোয়েন্দারা। তাই সরাসরি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে পারছিল না সে। কলকাতা থেকে গোপালের হয়ে তোলাবাজি করে টাকার জোগান দিচ্ছিল দিলীপ সোনকার নামে এক দুষ্কৃতী। দিন কয়েক আগে দিলীপকে পাকড়াও করে লালবাজার। তার পর থেকেই গোপালের টাকার জোগান কমে গিয়েছিল। এ ছাড়া সল্টলেকের দুষ্কৃতী হাতকাটা দিলীপকে হেফাজতে নেওয়াটাও কাজে দিয়েছে বলে পুলিশের একাংশের বক্তব্য। তার সঙ্গে গোপালের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল বলে জানা গিয়েছে। লালবাজারের অন্দরের খবর, গোপাল যে শহরে ফিরছে, তার ইঙ্গিত মিলেছিল হাতকাটা দিলীপের কাছ থেকেও। এ দিন যে হোটেল থেকে গোপালকে পাকড়াও করা হয়েছে, তা হাতকাটা দিলীপেরই এলাকায়। ওই
হোটেলের সঙ্গে দিলীপের যোগ রয়েছে। তবে দিলীপের ঘনিষ্ঠ কারও দিয়ে টোপ দিয়েই হোটেলে গোপালকে ডেকে আনা হয়েছিল কি না, তা খোলসা করতে চায়নি পুলিশ।
হোটেল সূত্রের খবর, গোপাল নিজের নামেই ঘর ‘বুক’ করেছিল। আজ, শুক্রবার ওই হোটেল ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল তার। এক রাতের জন্য হোটেলের ভাড়া ঠিক হয়েছিল ৩৭০০ টাকা। এ দিন গোপাল হোটেলে ঢোকার আগেই ষন্ডা চেহারার এক যুবক হোটেলে ঢুকে দরদাম করেন। তিনি হোটেলের একটি ‘রেট কার্ড’ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই গোপাল হোটেলে ঢোকে। তাকে হোটেলে পৌঁছে দেন আর এক যুবক। তবে গোপাল হোটেলে ‘চেক ইন’ করার সময়ই ওই যুবক চলে যান।
লালবাজারের দাবি, গিরিশ পার্ক কাণ্ডের পরে গোপাল শহর ছেড়ে পালিয়ে প্রথমে কর্নাটকে গিয়েছিল। সেখান থেকে মহারাষ্ট্রে ঘাঁটি গাড়ে সে। মহারাষ্ট্র থেকে যায় উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানায়। গোপাল হরিয়ানায় থাকার সময়েই তার টাকার জোগানদার দিলীপ সোনকার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তার পরেই হরিয়ানা থেকে রাজস্থানে পালিয়ে যায় গোপাল। রাজস্থানে তার বাড়ি রয়েছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। লালবাজারের একটি সূত্রের দাবি, দিন তিন-চার আগে গোপাল ফের আসানসোল দিয়ে এই রাজ্যে ঢোকে। তার পর থেকেই তক্কে তক্কে ছিলেন গোয়েন্দারা। কয়েক জন সোর্সও লাগানো হয়। আজ, শুক্রবার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হবে গোপালকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy