Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

সাঁতার শিখতে নেমে হেদুয়ায় মৃত্যু তরুণীর

স্বপ্ন ছিল আরও লম্বা হতে হবে, শরীরটা চনমনে রাখতে হবে। তাই দিন পনেরো আগে উত্তর কলকাতার হেদুয়ায় সাঁতার শেখা শুরু করেছিলেন সঙ্গীতা। মঙ্গলবার সকালে সেই মেয়ে তলিয়ে গেলেন অনেকের চোখের সামনে।

মৃত্যুর খবর জানার পরে সঙ্গীতার মা-বাবা। ছবি: রণজিৎ নন্দী

মৃত্যুর খবর জানার পরে সঙ্গীতার মা-বাবা। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৬ ০১:০৪
Share: Save:

স্বপ্ন ছিল আরও লম্বা হতে হবে, শরীরটা চনমনে রাখতে হবে। তাই দিন পনেরো আগে উত্তর কলকাতার হেদুয়ায় সাঁতার শেখা শুরু করেছিলেন সঙ্গীতা। মঙ্গলবার সকালে সেই মেয়ে তলিয়ে গেলেন অনেকের চোখের সামনে। বড়তলা থানার রামতনু বোস লেনের বাসিন্দা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্রীর এমন আকস্মিক মৃত্যুর পিছনে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি দেখছেন মৃতার পরিজনেরা। তাঁদের অভিযোগ, প্রশিক্ষকদের চূড়ান্ত গাফিলতিতেই জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে সঙ্গীতার। এই ঘটনায় তরুণীর সাঁতার প্রশিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আজাদ হিন্দ বাগ মহিলা সমিতির বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন তাঁরা। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে রাতে বড়তলা থানার সামনে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা।

সঙ্গীতাকে প্রতিদিন সাঁতারে নিয়ে যেতেন তাঁর পিসি অনিমা দাস। অনিমাদেবীর কথায়, ‘‘প্রতিদিনই কাকভোরে বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে বেরোতাম। সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ছ’টা ছিল ওর সাঁতার শেখার সময়। ওই সময়ে শুধু মেয়েরাই শেখে।’’ সঙ্গীতা যতক্ষণ জলে থাকতেন অনিমাদেবী ততক্ষণ জলাশয়ের চারপাশে প্রাতর্ভ্রমণ করতেন। সাড়ে ছ’টার সময়ে বেল বাজলে মেয়েরা জল থেকে উঠে ক্লাবের ভিতরে যেতেন পোশাক পরিবর্তন করতে। অন্যদের সঙ্গে সঙ্গীতাও পৌনে সাতটা নাগাদ বেরিয়ে আসতেন।

এ দিন নির্দিষ্ট সময়ের পরেও সঙ্গীতাকে বেরোতে না দেখে খোঁজ নিতে শুরু করেন অনিমাদেবী। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা সাঁতার শিখতে এসেছিলেন, তাঁদের বেরিয়ে যেতে দেখে ভেবেছিলাম ও বোধহয় তখনও পোশাক বদলাচ্ছে। কী করব ভাবছি, এমন সময় একটি মেয়ে এসে জানতে চায়, সঙ্গীতা কোথায়? সঙ্গীতাকে জলে দেখা যায়নি বলেও জানায় ওই তরুণী।’’ শুনে বুক কেঁপে ওঠে পিসির। তিনিই প্রশিক্ষকদের ঘটনাটি জানালে শুরু হয় খোঁজাখুঁজি।

নিয়ম অনুযায়ী, জলে নামার সময়ে এবং প্রশিক্ষণের পরে জল থেকে উঠে একটি খাতায় স্বাক্ষর করতে হয়। দেখা যায়, জলে নামার সময়ে খাতায় সই থাকলেও ওঠার পরের কলমে সঙ্গীতার সই নেই। এ-ও দেখা যায়, জলের পাশেই পড়ে রয়েছে তাঁর তোয়ালে। তা দেখে অভিজ্ঞেরা বুঝে যান, জল থেকে উঠে আসেননি সঙ্গীতা। তা হলে গেলেন কোথায়? এমন সাতপাঁচ ভাবনার মধ্যেই একে একে প্রশিক্ষকেরা পুলে ঝাঁপান। যোগ দেন অন্যেরাও। প্রায় মিনিট দশেক পরে পাড় থেকে কিছুটা দূরে গভীর জল থেকে উদ্ধার করা হয় সঙ্গীতার নিথর দেহ। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।

অভিযোগ উঠেছে, সঙ্গীতার দেহ জল থেকে তুলেই পালিয়ে যান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সদস্যেরা। মৃতের পরিবার বড়তলা থানায় ওই কেন্দ্রের সাত জনের নামে অভিযোগ দায়ের করেছে। প্রশিক্ষকদের চূড়ান্ত গাফিলতির জেরেই ওই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ তাঁদের।

সঙ্গীতা

কিন্তু গাফিলতি ঠিক কোথায়? বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, শিক্ষানবীশদের জন্য জলে মোট তিনটি ধাপ থাকে। প্রথমে পুলের পাড় ঘেঁষে একটি সংরক্ষিত জায়গায় সাঁতার শেখানো হয় নবাগতদের। সঙ্গীতাও সেখানেই সাঁতার শিখতেন। এখানে জলের গভীরতা থাকে প্রায় পাঁচ ফুট। এখানে সিমেন্টের থাম এবং তিনটি ধাপে লোহার রড থাকে। সেই রডের একটি শক্ত করে ধরে, শরীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে সাঁতার শেখা শুরু করেন নতুনরা। তাঁরা যেহেতু সাঁতার জানেন না, তাই পাশে সর্বক্ষণ প্রশিক্ষকদের থাকার কথা। কিন্তু অনিমাদেবীর অভিযোগ, এ দিন জলে নেমে পাশে থাকার বদলে পুলের উপর থেকেই বয়স্ক মহিলা প্রশিক্ষকেরা শিক্ষানবীশদের হাত-পা ছোড়া তদারকি করছিলেন। তাতেই চোখ এড়িয়ে গিয়েছে।

কী করে ডুবে গেলেন সঙ্গীতা? প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, হাত ফস্কে দু’টি রডের মাঝখান দিয়ে গলে পাশের পুলে চলে যান সঙ্গীতা। সেখানে জল সাত ফুট গভীর। সাঁতারের অ-আ-ক-খ শিখে তবেই এই পুলে নামার কথা ছিল সঙ্গীতার। প্রশ্ন উঠেছে, সকলে জল থেকে উঠে আসার পরে পাড়ে তোয়ালে পড়ে থাকা, খাতায় সই না-থাকা সত্ত্বেও তা কারও চোখে পড়ল না কেন? ‘‘ঠিক সময়ে নজরে এলে হয়তো এ ভাবে মরতে হতো না মেয়েটাকে’’— বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন সঙ্গীতার কাকা গোপাল দাস। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে এ দিন হাসপাতালে পৌঁছয় সঙ্গীতার পরিবার। বাবা নারায়ণচন্দ্র দাস একটি মুদি দোকানে কাজ করেন। সঙ্গীতার বড় দিদি মানসিক প্রতিবন্ধী। ছোট মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে বড়বাজারে কাপড়ের দোকানে কাজ করেন মা মণিকাদেবী। জানান, মেয়ে বলেছিল, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেয়ে গেলে আর মা-বাবাকে কাজ করতে দেবে না।

এ দিন ঘর থেকে বেরোনোর আগে মাকে সঙ্গীতা বলেছিল, ‘ভাত, ডাল তৈরি করে রেখো।’ বাবা দোকানে না গিয়ে একসঙ্গে খাবেন বলে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সঙ্গীতার বদলে এল দুঃসংবাদ। বুক চাপড়ে একনাগারে কাঁদছিলেন মণিকাদেবী। বারবার বলছিলেন, ‘‘যে প্রশিক্ষকদের জন্য আমার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের শাস্তি চাই।’’

বাচ্চারা সাঁতার শেখার সময়ে শুধু প্রশিক্ষক বা নজরদারের উপরেই ভরসা করে থাকেন না অভিভাবকেরা। নিজেরাও উপস্থিত থাকেন। দক্ষিণ কলকাতার একটি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিকেলবেলা নিয়মিত মায়ের সঙ্গে আসে ছ’বছরের অনুপম দাশগুপ্ত। মা স্বপ্নাদেবী জানালেন, ‘‘ছেলে যতক্ষণ জল থেকে না ওঠে, আমি চোখ সরাই না। জানি কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট সচেতন ও দায়িত্ববান, তবুও নিজে না থাকলে শান্তি পাই না।’’

বেলেঘাটা থেকে কলেজ স্কোয়ারের কেন্দ্রে ছেলেকে নিয়ে আসেন প্রসেনজিৎ ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে এক জন প্রশিক্ষক উপর থেকে নজর রাখেন, অন্য জন থাকেন জলে। আজকের ঘটনা শুনে আমি হতবাক। মেয়েটির পরিবারের অভিযোগ সত্যি হলে এ তো ভয়ঙ্কর ঘটনা! তবে কলেজ স্কোয়ার অনেক নিরাপদ। ক্লাবেই নবাগতদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে।’’

উত্তর কলকাতার হেদুয়া পার্কে যে পুকুরে এ দিন দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানেই ন্যাশনাল ক্লাবে সাঁতার শেখে ছ’বছরের সৌম্যপ্রিয় দাস। এ দিনের ঘটনায় আতঙ্কিত তাঁর মা মৌসুমী। বললেন, ‘‘আমি প্রতিদিনই জলের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। যদিও প্রশিক্ষকেরা সব সময়েই ওদের সঙ্গে থাকেন। এই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার ত্রুটি নেই। তবুও আজকের ঘটনাটা চিন্তা বাড়িয়ে দেবে। কর্তৃপক্ষ যেন আরও সচেতন হন ও বাড়তি সুরক্ষার ব্যবস্থা নেন, সে ব্যাপারে অভিভাবক হিসেবে কর্তৃপক্ষকে জানাব।’’

পুলিশ সূত্রে খবর, এই ঘটনায় চার জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের নামে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।

অন্য বিষয়গুলি:

Girl drown swim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE