লড়াই: রোজগারের জন্য ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করেন অনেক খাবার সরবরাহকর্মী। ছবি: সুমন বল্লভ
ডান হাত মোটরবাইকের হ্যান্ডেলে।
বাঁ হাতে ধরা খাবার ভর্তি প্লাস্টিক।
সেই অবস্থায় সিগন্যাল লাল দেখেও গতি বাড়িয়ে রুবি মোড় পেরোনোর চেষ্টা করলেন অনলাইনে খাবার আনানোর একটি সংস্থার এক কর্মী। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেন না। বাসে ধাক্কা মারল মোটরবাইক। রক্তাক্ত বাইকচালককে ভর্তি করানো হল হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা জানালেন, প্রাণে বাঁচলেও শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়েছে। জীবনভর শয্যাশায়ী থাকতে হবে।
এক হাতে বাইক চালাবেন কেন? সরবরাহকর্মীদের তো সংস্থার দেওয়া ব্যাগে খাবার নিয়ে যাতায়াত করার কথা! দুর্ঘটনাগ্রস্তের স্ত্রী বললেন, “চার বছর আগে ডেলিভারি বয়ের কাজ শুরু করার সময়ে ১৫০০ টাকা জমা নিয়ে সংস্থা দুটো টি-শার্ট আর একটা ব্যাগ দিয়েছিল। ওই ব্যাগ কি এত দিন টেকে! নতুন ব্যাগ নিতে গেলে ৮০০ টাকা দিতে হবে। রাত-দিন ছুটে বেড়িয়ে যা আয় হয়, তাতে ব্যাগ নেওয়ার টাকা কোথায়? ইনসেন্টিভও তো আগের মতো নেই।”
অভিযোগ, ইনসেন্টিভের হাতছানিতেই দেদার ছুটে বেড়াতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছেন সরবরাহকর্মীরা। অনেকেই ট্র্যাফিক-বিধি মানছেন না। সহজ রাস্তা নিতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছেন একমুখী রাস্তায় বাইক চালানোর নিয়ম। বহু সরবরাহকর্মী আবার হেলমেটও পরছেন না বলে অভিযোগ।
কলকাতা পুলিশেরই হিসেব বলছে, গত এক বছরে খাবার পৌঁছে দিতে যাওয়ার পথে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই সংখ্যাকে ছাপিয়ে গিয়েছে ডিসেম্বরের পয়লা থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত কলকাতার পথে ঘটা দুর্ঘটনা। টানা কয়েক মাস লকডাউন চললেও গত এক বছরে শহরে মোটরবাইকে সওয়ার সরবরাহকর্মীদের ঘিরে দুর্ঘটনার মামলা রুজু হয়েছে ৩১৬টি। শীতের মরসুমে যা বেড়েছে। গত দু’মাসেই এমন দুর্ঘটনার মামলা হয়েছে ২৯৮টি। গত এক বছরে পথে মৃত্যু হয়েছে ৩৮ জন সরবরাহকর্মীর। বিধাননগর পুলিশ এই ধরনের সরবরাহকর্মীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ট্র্যাফিক-বিধির পাঠ দেওয়ার কর্মশালা শুরু করেছে। কলকাতা পুলিশও তেমন পরিকল্পনা করছে বলে খবর।
সরবরাহকর্মীরা অবশ্য জানাচ্ছেন, লকডাউনের পর থেকে অনেকটাই কমে গিয়েছে ইনসেন্টিভ। পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে খাবার পৌঁছলে হাতে আসে ১৫ টাকা। এর পরে কিলোমিটার-পিছু পাঁচ টাকা করে। কয়েকটি সংস্থায় আবার মেলে প্রতি কিলোমিটারে তিন টাকারও কম। তবে সারা দিনে খাবার পৌঁছে ২৮০ টাকা আয় করলে বাড়তি ৯০ টাকা ইনসেন্টিভ দেয় সংস্থা। ৩৬০ টাকা আয় হলে মেলে বাড়তি ১১০ টাকা। কিন্তু সরবরাহকর্মীদের দাবি, এক দিনে টানা ১২ ঘণ্টা বাইক নিয়ে ছুটলেও ৩৬০ টাকা আয় হয় না। ফলে ১১০ টাকা বাড়তি পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
শ্যামল জানা নামে এক সরবরাহকর্মী বললেন, “১০ ঘণ্টা কাজ করে কেউ ২৮০ টাকা আয় করলেও ছুটি নেই। ৯০ টাকা ইনসেন্টিভ পেতে সে দিন রাত ১২টা পর্যন্ত অনলাইন থাকতে হয়।” সুধীর বিশ্বাস নামে আর এক কর্মীর কথায়, “এই আয় থেকেও অনেক সময়ে টাকা কেটে নেওয়া হয়। প্রতি বার রেস্তরাঁ থেকে খাবার তোলার পরে নিজস্বী তুলে সংস্থার অ্যাপে আপলোড করতে হয়। সেই সময়ে সংস্থার দেওয়া পোশাক পরে থাকা বাধ্যতামূলক। পোশাক পরে নিজস্বী দেওয়া সত্ত্বেও পোশাক পরছি না বলে অহরহ টাকা কাটা হচ্ছে।” অনেকে জানালেন, বাইক চালানোর মধ্যেই মোবাইলে নানা বার্তা আসে। উত্তর দিতে হয় তৎক্ষণাত। না হলেই টাকা কাটা যাওয়ার ভয়।
অনলাইনে খাবার আনানোর এমনই একটি সংস্থার সিইও দীপেন্দ্র গয়ালের দাবি, সরবরাহকর্মীদের নিরাপত্তা তাঁদের কাছে সবার আগে। এ জন্য তাঁরা ওই কর্মীদের বিমার ব্যবস্থাও করেছেন। লকডাউনে আর্থিক সাহায্যও দিয়েছেন। আর একটি সংস্থার কলকাতা শাখা জানিয়েছে, দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধির নিরিখে প্রতি জ়োনে এক জন করে আধিকারিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনিই সচেতন করার পাশাপাশি বিমার ব্যবস্থা করছেন।
সুরজিৎ সাহা নামে এক সরবরাহকর্মী অবশ্য বললেন, “খাবার দিতে যাওয়ার পথে লরির ধাক্কায় আহত হই দেড় বছর আগে। বিমার কোনও টাকাই পাইনি। সংস্থা বলেছিল, এক ও পাঁচ লক্ষ টাকার দুটো বিমা আছে। ওই বিমা রয়েছে মোবাইলের মেসেজেই। হাতে কিছু আসে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy