Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Jadavpur University Student Death

যাদবপুরকাণ্ডে গ্রেফতার ৯ থেকে বেড়ে ১২, কী ভাবে চলত র‌্যাগিং, নবাগতেরাও ‘তথ্য’ জোগাচ্ছেন পুলিশকে

যাদবপুরকাণ্ডে ধৃত আরও তিন জন। তাঁদের মধ্যে দু’জন প্রাক্তনী রয়েছেন। অন্য দিকে, তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, তাঁরা প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন, কী কী হয় হস্টেলে।

First year students say to police how they were treated in hostel, three more arrested

যাদবপুরকাণ্ডে এখনও পর্যন্ত মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২৩ ২৩:৪১
Share: Save:

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় আরও তিন জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। এই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১২ জন ছাত্র এবং প্রাক্তনী পুলিশের জালে।

শুক্রবার সকাল থেকেই সন্দেহের তালিকায় থাকা এক বর্তমান এবং দুই প্রাক্তন ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। রাতে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ সূত্রে আরও খবর, হস্টেলে নবাগত প্রথম বর্ষের ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, 'কী কী ভাবে নির্যাতন চালাতেন হস্টেলের সিনিয়রদের একটা অংশ'। ওই ধরনের নির্যাতন মৃত ছাত্রের উপরেও হয়েছিল কি না, এবং ওই নির্যাতনে আরও কেউ জড়িত কি না তা-ও দেখছেন তদন্তকারীরা।

তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, ৯ অগস্ট রাতে পড়ে যাওয়ার পর যখন মৃতপ্রায় ওই ছাত্রকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার তোরজোড় চলছিল, তখন হস্টেলে ‘জরুরি বৈঠক’ বসানো হয়েছিল। তার ‘হোতা’ ছিলেন অন্যতম অভিযুক্ত সৌরভ চৌধুরী (বর্তমানে তিনি গ্রেফতার হয়ে পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন)। পুলিশকে কী বলতে হবে, তা-ই মূলত ছিল আলোচ্য বিষয়। যদিও ধরা পড়ার পর ক্রমেই অভিযুক্তদের বয়ানে মিলেছে একাধিক অসঙ্গতি। বিপাকে পড়ে একে অন্যের দিকে আঙুল তুলতেও ছাড়েননি তাঁরা। এমনটাই জানা গিয়েছে তদন্তকারীদ্র সূত্রে।

ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে ন’জনকে। তাঁদের গ্রেফতার করার পরেও পুলিশের নজরে ছিলেন হস্টেলের আরও কয়েক জন আবাসিক। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রাক্তনীরাও। শুক্রবার সকাল থেকে তিন পড়ুয়াকে যাদবপুর থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিল পুলিশ। শেষ পর্যন্ত তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। ধৃতেরা হলেন শেখ নাসিম আখতার, সত্যব্রত রায় এবং হিমাংশু কর্মকার। অভিযুক্তদের পাশাপাশি প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তাঁদের বয়ানেই জানা গিয়েছে, হস্টেলের অন্দরে নতুন পড়ুয়াদের সঙ্গে কী ঘটত। প্রথম বর্ষের ওই পড়ুয়ারা জানিয়েছেন, শৌচালয় থেকে ঘর— সবই পরিষ্কার করতে হত তাঁদের। সিনিয়রদের অনুমতি ছাড়া বাড়িতে ফোন করা বারণ ছিল। এমনকি, বাড়িতে যখন ফোন করেন নবাগতেরা, তখন সেখানে উপস্থিত থাকেন সিনিয়রেরা। মৃত ছাত্রের সঙ্গেও কি এমন আচরণই করা হয়েছিল? খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

এ সবের পাশাপাশি, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই কাণ্ডে ধৃত ন’জনকেও ক্রমাগত জেরা করা হচ্ছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। তাঁদের মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করার ভাবনা রয়েছে পুলিশের। আর এই জেরার চাপেই একের পর এক ‘তথ্য’ ফাঁস করে চলেছেন ধৃতেরা, এমনটাই জানা গিয়েছে তদন্তকারীদের একাংশের সূত্রে। নিজেদের বাঁচাতে একে অপরের দিকে আঙুল তুলছেন তাঁরা। এ রকম পরিস্থিতি হতে পারে ধরে নিয়েই কি ৯ অগস্ট রাতে ‘জরুরি বৈঠক’ ডাকা হয়েছিল হস্টেলের অন্দরে? ওই হস্টেলের এক আবাসিক ছাত্রকে জেরা করে তেমনটাই জানা গিয়েছে বলে তদন্তকারীদের একাংশের দাবি। ওই আবাসিক পড়ুয়া জেরায় জানিয়েছেন, পড়ে যাওয়ার পর মৃতপ্রায় ছাত্রকে নিয়ে যখন হাসপাতালে যাওয়ার তোরজোড় চলছিল, তখন হস্টেলে ‘জরুরি বৈঠক’ করেন অভিযুক্ত সৌরভ। যিনি ‘মহাপাকা’ নামেই পরিচিত হস্টেলে। ওই আবাসিকের বয়ানেই জানা গিয়েছে, পুলিশকে কী বলতে হবে, তা নিয়েই আলোচনা হয়েছিল। সকলের বয়ান যাতে একই রকম থাকে, তারও ‘পাঠ’ দিয়েছিলেন সৌরভ। বৃষ্টির কারণে খোলা জায়গার সেই বৈঠক ভেস্তে যায়। পরে ফের বৈঠক বসানো হয় হস্টেলের অন্দরে। যদিও পুলিশি জেরায় সেই ‘পাঠ’ ধোপে টেকেনি। উল্টে ধৃতেরা একে অপরের দিকে আঙুল তুলেছেন। দোষারোপ করেছেন।

এ সবের মধ্যেই শুক্রবার যাদবপুরকাণ্ডে মৃত ছাত্রের পরিজনজদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মৃত ছাত্রের মামাবাড়িতে গিয়ে তাঁর মা-বাবা এবং মামাদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তৃণমূল যদিও দাবি করেছে, এই সফর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

অন্য দিকে, যাদবপুরে বিজেপি যুব মোর্চার মঞ্চ খুলে ফেলা হয় শুক্রবার। বৃহস্পতিবার ওই ধর্না মঞ্চেই শুভেন্দুর ভাষণের পর সংঘর্ষ বেধেছিল। বিজেপির দাবি, পুলিশ আচমকা তাদের অনুমতি বাতিল করেছে। যদিও পুলিশ জানিয়েছে, অনুমতিই দেওয়া হয়নি। শুক্রবার সন্ধ্যাতেই যাদবপুরকাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধের জেরে তীব্র যানজট হয়। ব্যস্ত সময়ে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে যাদবপুর থানার সামনে রাস্তা।

ধৃত আরও তিন

যাদবপুরকাণ্ডে আরও তিন জনকে গ্রেফতার করল কলকাতা পুলিশ। শুক্রবার ওই তিন জনকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। পরে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় ধৃতের সংখ্যা বেড়ে হল ১২। শুক্রবার গ্রেফতার করা হয়েছে শেখ নাসিম আখতারকে। তিনি রসায়ন বিভাগের প্রাক্তনী। পূর্ব বর্ধমানের মেমারির বাসিন্দা নাসিম। হিমাংশু কর্মকার নামে আরও এক প্রাক্তনীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর বাড়ি মুর্শিদাবাদের সমশেরগঞ্জে। এ ছাড়া সত্যব্রত রায় নামে চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র। তাঁর বাড়ি নদিয়ার হরিণঘাটায়। উল্লেখ্য, এই সত্যব্রতই ঘটনার দিন অর্থাৎ, বুধবার রাতে ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়কে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, হস্টেলে ‘পলিটিসাইজ়ড’ হচ্ছে। ব্যাখ্যা দিয়ে জানিয়েছিলেন, হস্টেল থেকে এক ছাত্রকে ঝাঁপ দিতে বলা হচ্ছে। তাঁকেও টানা জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

হস্টেলে কী চলত

পড়ুয়ারা হস্টেলে নতুন এলে তাঁদের সঙ্গে ঠিক কেমন আচরণ করা হত, তারও আভাস জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁরা জানতে পেরেছেন বলে জানালেন তদন্তকারীদের একাংশ। শুক্রবার বেশ কয়েক জন প্রথম বর্ষের পড়ুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তাতেই উঠে এসেছে ‘তথ্য’। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শৌচালয় থেকে হস্টেলের ঘর, সবই সাফাই করতে হত নতুন পড়ুয়াদের। সিনিয়রদের ভাত বেড়ে দেওয়া, মশারি টাঙিয়ে দেওয়ার কাজও করতে হত তাঁদের। মৃত ছাত্রকে দিয়েও এ সব করানো হয়েছিল কি না, খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তদন্তকারীরা আরও জানতে পেরেছেন, সিরিয়রদের অনুপস্থিতিতে, তাঁদের অনুমতি ছাড়া নিজেদের বাড়িতেও ফোন করতে পারতেন না নতুন পড়ুয়ারা। মৃত ছাত্রের মায়ের দাবি, ছেলে যখন তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন, তখন সেই ফোন নিয়ে কথা বলেছিলেন অভিযুক্ত সৌরভ চৌধুরী। আশপাশে সে সময় ছিলেন আরও কয়েক জন ছাত্র। মৃত ছাত্রের মা জানিয়েছেন, তিনি র‌্যাগিং নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করলে সৌরভ তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, এ রকম কিছু হবে না। পরে অন্য এক জনের ফোন থেকে মৃত ছাত্রের বাড়িতে ফোন করা হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, আরিফের মোবাইল থেকে ফোন করা হয়েছিল। ওই ছাত্রকে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতে বাধা দেওয়া হয়েছিল কি না, তা-ও এখন খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

মুখোমুখি জেরা

শুক্রবার সকাল পর্যন্ত যাদবপুরকাণ্ডে গ্রেফতার হয়েছেন ন’জন। রাতে আরও তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। শুক্রবার সকালে পুলিশ সূ্ত্রে জানা গিয়েছিল, ধৃত ন’জনের বক্তব্যে একাধিক অসঙ্গতি পাওয়া গিয়েছে। এক এক জন এক এক রকম কথা বলছেন বলে দাবি করে পুলিশের একটি সূত্র। কে সঠিক কথা বলছেন? সত্যের খোঁজে তাই ধৃত ন’জনকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হতে পারে। যদিও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাঁদের মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হয়নি বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। এই ঘটনায় গত শুক্রবার প্রথম গ্রেফতার করে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী এবং হস্টেলের আবাসিক সৌরভ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। রবিবার সকালে আরও দুই পড়ুয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ— দীপশেখর দত্ত এবং মনোতোষ ঘোষ। তাঁদের জেরা করে বুধবার আরও ছ’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, ধৃতদের মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলি থানা এলাকার বাসিন্দা অসিত সর্দার, মন্দিরবাজারের সুমন নস্কর এবং পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার বাসিন্দা সপ্তক কামিল্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। বাকিরা, জম্মুর বাসিন্দা মহম্মদ আরিফ (তৃতীয় বর্ষ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), পশ্চিম বর্ধমানের বাসিন্দা আসিফ আফজল আনসারি (চতুর্থ বর্ষ, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা অঙ্কন সরকার (তৃতীয় বর্ষ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) এখনও পড়াশোনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই ন’জনকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরার চিন্তাভাবনা রয়েছে পুলিশের। শুক্রবার রাতে গ্রেফতার হন আরও তিন জিন। তাঁদেরও মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হবে কি না, এই খবর প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত জানা যায়নি।

ঘটনার পুনর্নির্মাণ

তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ধৃতদের বয়ানে অসঙ্গতি রয়েছে। নিজে বাঁচতে একে অপরের দিকে আঙুলও তুলেছেন অভিযুক্তদের কেউ কেউ। এর মধ্যেই শুক্রবার অভিযুক্ত সপ্তককে নিয়ে যাওয়া হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে। ৯ অগস্ট রাতে সেখানে ঠিক কী ঘটেছিল, সপ্তককে সঙ্গে নিয়ে তার পুনর্নির্মাণ করায় পুলিশ। শুক্রবার দুপুর দেড়টা নাগাদ শুরু হয়ে দুপুর ২টো ৪০ মিনিট পর্যন্ত চলে সেই প্রক্রিয়া। তার পর সপ্তককে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যাদবপুর থানায়। কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ শহরতলি) বিদিশা কলিতা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে চলে এই পুনর্নির্মাণের কাজ। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ধৃতদের প্রত্যেককে দিয়ে এই পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়া চলবে। এক এক জনের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া শেষ হতে এক দিনের বেশি সময়ও লাগতে পারে। যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে, সপ্তক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সপ্তকের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায়।

একে অন্যের দিকে আঙুল

৯ অগস্ট রাতে যাদবপুরের হস্টেলে কী ঘটেছিল, এখন তা জানতেই মরিয়া পুলিশ। ধৃতদের বয়ানে একাধিক অসঙ্গতি। সে কারণে তাঁদের মুখোমুখি বসিয়ে জেরার ভাবনা রয়েছে পুলিশের। তদন্তকারীরা জানতে চান, ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুর নেপথ্যে কার কতটা হাত রয়েছে। যদিও তা নিয়েই এখন ধন্দ তৈরি হয়েছে। কারণ, অভিযুক্তেরা নিজেদের বাঁচাতে একে অন্যের দিকে আঙুল তুলছেন। পুলিশ সূত্রে খবর, ধৃতেরা সকলেই নিজেদের ‘বাঁচানোর চেষ্টা’ করছেন। অর্থাৎ, নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেল থেকে দু’টি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে আগেই। ওই জোড়া ডায়েরি এবং একটি চিঠি ঘিরে রহস্য তৈরি হয়েছে। এই নিয়েও ধৃতদের বয়ানে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ১০ অগস্ট হস্টেলে তল্লাশি চালিয়ে ৬৮ নম্বর ঘর থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই ঘরেই থাকতেন নির্যাতিত ছাত্র। তবে সেই ডায়েরিতে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। সৌরভকে গ্রেফতারের পর তাঁকে জেরাপর্বে একটি চিঠির বিষয় উঠে আসে। সেই চিঠির সূত্র ধরেই গত ১২ অগস্ট রাতে ওই ১০৪ নম্বর ঘরে তল্লাশি চালিয়েছিল পুলিশ। তার পরেই উদ্ধার করা হয় দ্বিতীয় ডায়েরি। ডায়েরির ১৫১ নম্বর পৃষ্ঠায় ওই চিঠির উল্লেখ রয়েছে। চিঠিটি কে লিখেছিলেন? এই নিয়েও নানা বয়ান উঠে এসেছে। নিহত ছাত্রকে দিয়ে চিঠিটি লেখানো হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু ধৃত ছাত্র দীপশেখর দত্ত জেরায় দাবি করেন যে, নির্যাতিত ছাত্রের হয়ে তিনিই চিঠিটি লিখেছিলেন।

সেই রাতে ‘বৈঠক’

মেন হস্টেলের এ-২ ব্লকের তিনতলার বারান্দা থেকে পড়ে যাওয়া ছাত্রকে যখন হাসপাতালে পাঠানোর তোড়জোড় চলছে, তখন ডি ব্লকের নীচে বিশেষ বৈঠক বক্তৃতা করছিলেন প্রাক্তনী সৌরভ। যাদবপুরে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় যাঁকে প্রথম গ্রেফতার করে পুলিশ। হস্টেলে ‘মহাপাকা’ নামে পরিচিত ছিলেন সৌরভ। হস্টেলের এক আবাসিক পুলিশকে জানিয়েছেন, সে দিন সৌরভই তাঁদের জানিয়েছিলেন, প্রথম বর্ষের ওই ছাত্র কী ভাবে হঠাৎ তিন তলা থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। বৈঠকে সৌরভ বলেছিলেন, ‘‘ছেলেটি আগে থেকেই কোনও কারণে উত্তেজিত ছিল। এবং ‘আমি সমকামী নই’ বলে চিৎকার করতে করতে হস্টেলের নানা জায়গায় উত্তেজিত ভাবে ছোটাছুটি করছিল সে।’’ পুলিশের কাছে এমনই দাবি করেছেন মেন হস্টেলের এ-২ ব্লকের ওই আবাসিক। ছাত্রটি জানিয়েছেন, সৌরভের ওই দাবিকে সে দিন বৈঠকে কিছুটা সমর্থনও করেছিলেন অর্থনীতির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র দীপশেখর। পুলিশ তাঁকেও ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে। ওই ছাত্রের বয়ান থেকেই জানা গিয়েছে, ৯ অগস্ট রাতের ওই বৈঠক কিছু ক্ষণের জন্য বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ বৈঠকটি ডি ব্লকের নীচে ফাঁকা জায়গায় হচ্ছিল। বৃষ্টি নামায় সবাই ভিতরে চলে যান। এর পর মুলতবি হওয়া বৈঠক আরও এক বার বসে। তার পরে ওই রাতে আরও এক বার বৈঠক ডাকা হয়। দ্বিতীয় বার আলোচনার বিষয় ছিল হস্টেল সুপারের ফোন। পুলিশকে দেওয়া বয়ানে হস্টেলের চার তলার ওই আবাসিক জানিয়েছেন, এই ঘটনার পর ফোন করে হস্টেল সুপার কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন। যা মেনে চলারই সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। পুলিশকে দেওয়া হস্টেল পড়ুয়ার বক্তব্য অনুযায়ী, হস্টেলে কী হয়েছে, এর পরে কী করণীয়, এই সব কিছু নিয়ে ওই জরুরি বৈঠকে আলোচনা করেছিলেন সৌরভ।

খোলা হল বিজেপির মঞ্চ

খুলে ফেলা হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিজেপি যুব মোর্চার মঞ্চ। বৃহস্পতিবার ওই ধর্না মঞ্চেই শুভেন্দুর ভাষণের পর সংঘর্ষ বেধেছিল। শুক্রবার সেখানে বিজেপির যুব মোর্চার কর্মসূচিও ছিল। তার আগে সেই মঞ্চ খোলার কাজ শুরু হয়। যুব মোর্চার অভিযোগ, পুলিশ তাদের কর্মসূচির অনুমতি বাতিল করে মঞ্চ খুলে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। এরই প্রতিবাদে ধর্না মঞ্চের সামনে অবস্থান বিক্ষোভে বসে পড়েন যুব মোর্চার কর্মীরা। যুব মোর্চার তরফে দাবি, ১৯ অগস্ট পর্যন্ত কর্মসূচির কথা জানিয়ে যাদবপুর থানা থেকে মঞ্চ বাঁধার অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শুক্রবার আচমকাই পুলিশের তরফে অনুমতি বাতিল করে দেওয়া হয়। আধ ঘণ্টার মধ্যে মঞ্চ খুলে ফেলার নির্দেশ দেয় পুলিশ। ডেকরেটার্সদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, সময়ের মধ্যে মঞ্চ খোলা না হলে সব কিছু বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর পরেই বাধ্য হয়ে মঞ্চ খুলে নেওয়া হয় বলে জানানো হয়েছে যুব মোর্চার তরফে। যদিও পুলিশের বক্তব্য, এই ধরনের কোনও অনুমতিই দেওয়া হয়নি। যুব মোর্চার সভাপতি ইন্দ্রনীল খাঁ র দাবি, তাঁদের ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যদিও পুলিশের তরফে এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কিছু জানানো হয়নি।

শুভেন্দুর পরামর্শ

যাদবপুরকাণ্ডে মৃত ছাত্রের পরিজনজদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মৃত ছাত্রের মামাবাড়ি গিয়ে তাঁর মা-বাবা এবং মামাদের সঙ্গে কথা বলেন শুভেন্দু। সেখানে বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘দ্রুত বিচার চাইলে আদালতের হস্তক্ষেপের প্রার্থনা করুন।’’এর আগে বুধবার মৃত পড়ুয়ার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিরা। সেখানে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু আশ্বাস দেন, এই ঘটনার বিচার হবেই। কারণ, বিষয়টি দেখছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নদিয়ার বগুলায় গিয়ে মৃতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি। শুক্রবার ওই ছাত্রের মায়ের সঙ্গে আলাদা করে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলেন শুভেন্দু। বিরোধী দলনেতার সঙ্গে বিজেপি বিধায়কদের ১৭ জনের একটি দল ছিল। তাতে ছিলেন বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকারও। পরিবারের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন শুভেন্দু। অন্য দিকে, শুভেন্দুদের এই সফরকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে কটাক্ষ করেছে তৃণমূল।

মিছিলে অবরুদ্ধ যাদবপুর

যাদবপুরকাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধের জেরে তীব্র যানজট হল শুক্রবার সন্ধ্যায়। ব্যস্ত সময়ে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে যাদবপুর থানার সামনে রাস্তা। এই পরিস্থিতিতে অবরোধকারীদের সঙ্গে বচসায় জড়ান পথচারীরা। শুক্রবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, নাগরিক সমাজ এবং রূপান্তরকামীদের মিছিল বেরিয়েছিল। সন্ধ্যায় ওই তিনটি মিছিলই যাদবপুর থানার মোড়ে এসে পৌঁছয়। সেখানে বিক্ষোভকারীদের অনেকেই রাস্তায় বসে পড়ে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন। তিনটি মিছিলের জেরে ব্যাহত হয় যান চলাচল। স্থানীয় সূ্ত্রে খবর, দীর্ঘ ক্ষণ পথ আটকে বিক্ষোভ চলায় ঢাকুরিয়া পর্যন্ত যানজট তৈরি হয়। ক্ষুব্ধ হন নিত্যযাত্রীরা। পরে অবশ্য পুলিশের হস্তক্ষেপে খোলা হয় অবরুদ্ধ রাস্তার কিছু অংশ।

নিন্দা সৌরভ গাঙ্গুলীর

যাদবপুরে পড়ুয়ামৃত্যুর ঘটনা নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানালেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক তথা বিসিসিআই-এর প্রাক্তন সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। শুক্রবার কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে সৌরভ বলেন, ‘‘অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। র‍্যাগিং বন্ধ করার জন্য তাড়াতাড়ি আইন আনা দরকার।”

অন্য বিষয়গুলি:

Jadavpur University Student Death Jadavpur University arrest police investigation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy