বড় পর্দায় এই প্রথম দম্পতি হিসেবে অঞ্জন দত্ত এবং অপর্ণা সেন। ছবি: সংগৃহীত।
ছবি যখন বাণিজ্যিক ভাবে মুক্তি পায়, মূলত বাণিজ্য করার জন্যই পায়। তবে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত, মূলত অপর্ণা সেন ও অঞ্জন দত্ত অভিনীত ‘এই রাত তোমার আমার’ সিনেমাটি বক্স অফিসে বিরাট ব্যবসা করবে, এমন আশা বোধহয় ছবিটির প্রযোজক বা পরিচালক কেউই করেন না। তবে যে বিষয়টি শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া উচিত— একটি অত্যন্ত ভাল চিত্রনাট্যের সার্থক এবং সর্বোপরি সৎ সিনেমার রূপায়ণ পেরেছেন পরমব্রত, এবং সেই প্রচেষ্টাকে ঠিকঠাক লালন করেছেন প্রযোজক। এই মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কারণ বাংলা বাজারে নির্ভেজাল বাণিজ্যিক সিনেমার যতটা প্রয়োজন, ঠিক ততটাই প্রয়োজন এই ধরনের ছবিকে যত্নে লালন করার, এমন ভাবনাকে আর্থিক ভাবে সমর্থন করার। তাতে যাকে আজকাল ‘ইন্ডাস্ট্রি’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তার স্বাস্থ্য ও শরীর দু’টিই ভাল থাকে। লক্ষ্মীর বসতও থাকে, সরস্বতীরও। অর্থ, বাণিজ্য এবং মানের উচ্চতা সব ক’টি দিকই বজায় থাকে।
‘এই রাত তোমার আমার’-এর নায়ক-নায়িকা অঞ্জন দত্ত এবং অপর্ণা সেন। প্রথম জন এখন ৭৫, দ্বিতীয় জন প্রায় ৮০। অর্থাৎ দু’জনেই বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে গিয়েছেন। এই বয়সের অভিনতাদের এ দেশে সিনেমার মুখ্য মুখ হিসাবে তুলে ধরার চল খুব বেশি দেখা যায় না। তার জন্য যতটা সাহস এবং ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজন হয়, ততটাই হয় সেই দুই অভিনেতার অভিনয় প্রতিভার উপর অগাধ বিশ্বাসের। পরমব্রতকে সাধুবাদ, পরিচালক হিসাবে তিনি প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই সঠিক সিদ্ধান্তগুলি নিতে পেরেছেন। বলা যায়, স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্তগুলিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং প্রচণ্ড ভাবে সফল হয়েছেন। কারণ চিরঞ্জীব বরদোলইয়ের গল্প ও হিন্দি ভাষায় লেখা মূল চিত্রনাট্যে (যাকে বাংলায় রূপান্তরিত করতে এবং আরও সমসাময়িক করতে হাত লাগিয়েছেন পরিচালক স্বয়ং), কোথাও মোটা দাগের আবেগপ্রবণতা বা অতি নাটকীয় অভিনয়ের কোনও সুযোগ ছিল না। অপর্ণা এবং অঞ্জন, দু’জনেই আধুনিক অভিনয়ের সংজ্ঞাটি ঠিক কী, তা এই মুহূর্তে টলিগঞ্জে হয়তো সবচেয়ে ভাল অনুভব করেন, এবং তাঁদেরই নিজের ছবির নায়ক-নায়িকা বাছা পরমব্রতের সাহস এবং ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতার প্রমাণ রাখে।
অপর্ণা এবং অঞ্জন, দু’জনের ব্যক্তিত্বেই মূল ধারাগুলি হল, দু’জনেই ভীষণ আড্ডাবাজ মানুষ, এবং দু’জনেই সমান ভাবে পড়াশোনা করেন নিজেদের শিল্প নিয়ে। মনের দরজা-জানালা খোলা রাখেন, এবং বয়সের তোয়াক্কা না করেই অসমবয়সিদের সঙ্গে সমানতালে মিশতে পারেন। এই গুণগুলির জন্যই হয়তো, দু’জনের কেউই এই বয়সেও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাননি। বাড়তি পাওনা, অপর্ণা আজও সমান ‘গ্ল্যামারস’। ‘গ্ল্যামার’-এর বাংলা যদি লাবণ্য হয়, তা হলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, অপর্ণার লাবণ্যে তাঁর বয়স একফোঁটাও ছাপ ফেলতে পারেনি। অঞ্জন, ভারতীয় সিনেমা ব্যাকরণ অনুযায়ী তথাকথিত নায়কোচিত চেহারার না হতে পারেন, কিন্তু তিনি ব্যক্তিত্বের স্বতঃস্ফূর্তি দিয়ে সেই ঘাটতি খুব সহজেই অতিক্রম করতে পারেন। এই বয়সেও অঞ্জন দত্ত নামটি দু’পারের বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের কাছে সমান জনপ্রিয়। দু’জনেই অনস্বীকার্য ভাবে তুখোড় অভিনেতা, এবং দু’জনেরই প্রচণ্ড জীবনীশক্তি। বৃদ্ধ যুগলের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য, তাদের শরীরী ভাষা আয়ত্ত করতে, এই বয়সেও তাঁরা অভিনেতা সোহাগ সেনের কর্মশালায় যোগদান করেছেন, অনুশীলন করেছেন, শুটিং শুরুর আগে। নিজের শিল্পের প্রতি এই পর্যায়ের অঙ্গীকারবদ্ধতা যে এই বয়সেও তাঁদের মধ্যে রয়েছে, সেই জ্ঞানই তো চমকপ্রদ। পরিচালক এবং তাঁর সঙ্গীসাথীদের, নিজেদের কাজের প্রতি এই উত্সর্গীকৃত দৃষ্টিভঙ্গিই সিনেমায় প্রতিফলিত হয়েছে।
অথচ ছবিতে দু’জনেই অসুস্থ। অপর্ণার চরিত্র, জয়িতা, কর্কট রোগাক্রান্ত, এবং সিনেমা যখন শুরু হয়, সে সময়ে জয়িতা প্রায় রোগের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে। জয়িতার কেমোথেরপি চলছে, এবং তার শরীরে সেই ধকল প্রবল ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তার চলাফেরায় অপরিসীম ক্লান্তি, তার চোখের কোলে গাঢ় কালো ছাপ স্পষ্ট। অঞ্জনের চরিত্রের নাম অমর। অমরের শরীরও খুব সুস্থ নয়। বয়সজনিত নানা ব্যাধি তাকেও গ্রাস করছে ধীরে। তাদের সংসারে সন্তান-সহ বিবাহিত পুত্রসন্তান (জয়: অভিনয়ে, পরমব্রত এবং মীরা: অভিনয়ে, শ্রুতি দাস) থাকা সত্ত্বেও তারা একাকী, কারণ চাকরিসূত্রে পুত্র ও পুত্রবধূ, সন্তানসহ প্রবাসী। বৃদ্ধ দম্পতি থাকে এক পাহাড়ি এলাকায়, দোতলা বাংলোয়। সুতরাং গুরুতর অসুস্থ স্ত্রী এবং সেই সঙ্গে সংসারের বেশির ভাগ ঝক্কিও অমরকেই সামলাতে হয়। সে তাই সহজেই দিনের শেষে কাবু হয়ে পড়ে। সঙ্গে আছে বেয়াদব কোমরব্যথা।
এমন ছবি বা কাছাকাছি বিষয়ে সিনেমা এর আগেও অন্তত একটি, সম্প্রতি হয়েছে বাংলায়। কিন্তু এই চিত্রনাট্যে কোথাও একফোঁটা আবেগের আতিশয্য নেই। সিনেমাটির গঠন এতটাই সঙ্গতি সম্পন্ন যে কোথাও কখনও এতটুকু বিপন্নতাবোধ আসে না। সংলাপে এক অদ্ভুত হালকা রসবোধ বর্তমান, যা ৫০ বছর একসঙ্গে কাটানো দম্পতির মধ্যেই একমাত্র পরিলক্ষিত হতে পারে। তাদের সম্পর্ক নিছক স্বামী-স্ত্রীর পর্যায় অতিক্রম করেছে, রূপ পেয়েছে বন্ধুত্বের। এক পারস্পরিক নির্ভরতা, সম্মানবোধ এবং বিশ্বাসের আকর্ষণে আবদ্ধ হয়েছে। এত দিন পাশাপাশি পথ চলতে, চলতে এমনই হওয়ার কথা। এইটিই স্বাভাবিক। এমন চিত্রনাট্য সৃষ্টি করা কিন্তু সহজ কাজ নয়। এর জন্য চিত্রনাট্যকারের কলমে এক দৃঢ় অথচ সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজন। নিজের কাজে নিয়ন্ত্রণ না থাকলে তা করা অসম্ভব। চিরঞ্জীব এবং পরমব্রত সেই কাজটি করেছেন দুর্দান্ত পারদর্শিতার সঙ্গে।
‘এই রাত তোমার আমার’ ছবিটির অন্যতম পরীক্ষা ছিল একটি অবদ্ধতা। একই বাড়ির মূলত দু’টি ঘরের মধ্যেই কাহিনি আবদ্ধ। তবু তার মধ্যে দর্শকের কৌতূহল বজায় রাখতে এমনই একটি ঝকঝকে চিত্রনাট্য এবং সংলাপের প্রয়োজন ছিল অনস্বীকার্য ভাবে। তার সঙ্গে আছে বুদ্ধিদীপ্ত সম্পাদনা (সুমিত চৌধুরী) এবং মসৃণ ক্যামেরার (প্রসেনজিৎ চৌধুরী) কাজ। দর্শকের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য আলো-আঁধারির এবং নানা ক্যামেরার লেন্সের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সুরারোপ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মোলায়েম। কখনওই কর্ণকন্টকের কারণ নয়। আসলে পুরো ছবিটিই একটি পরিশীলিত নিচু তারে বাঁধা। এবং সেই সুর কোথাও এতটুকু টাল খায় না। এইটিই পরিচালকের মুন্সিয়ানা। তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা নিজেদের কাজটুকু মন দিয়ে করেছেন। এমন সহকর্মী জড়ো করাটাই তো পরিচালকের তুখোড় প্রতিভার পরিচায়ক। সোমনাথ কুন্ডুর রূপসজ্জা, সাবর্ণী দাসের পোশাক পরিকল্পনা এবং হেমা মুন্সীর কেশসজ্জাও উচিত সঙ্গত করেছে বাকি সব ক্ষেত্রগুলির ভারসাম্যের সঙ্গে। ফলে পুরো কাজটিই প্রায় আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পেরেছে। উত্তর ইউরোপীয় ছবির কথা মনে করিয়ে দেয় ‘এই রাত তোমার আমার’। প্রতি পদে পরিশীলন এবং যত্নের ছাপ উজ্জ্বল করে রাখে এই সিনেমাদর্শনকে।
বছরের গোড়াতেই একই প্রযোজকের ঘর থেকে দু’টি উচ্চমানের সিনেমা মুক্তি পেল। বাংলায় এমন কাজের সঠিক লালনের জন্য এমন সংস্থা রয়েছে এটি স্পষ্ট। এমতাবস্থায় এই যে হৃদয় নিংড়ানো আবেদন, ‘বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান’, তার হয়তো অদূর ভবিষ্যতে প্রয়োজন ফুরোবে, এমন আশা করাই যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy