যাঁরা নিজেরাই তালা বন্ধ অবস্থায় বছরের পর বছর কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁরাই এ বার নিজের হাতে চাবি পেলেন। এ চাবি দিয়ে আপাতত বন্ধ দরজার তালা খোলা যাবে না ঠিকই, কিন্তু নিজেদের একটি পৃথক জগত তৈরির সুযোগ থাকবে। রাজ্যে প্রথম পাভলভ মানসিক হাসপাতালের রোগীদের জন্য নিজেদের লকার চালু করল স্বাস্থ্য দফতর। এর পরে ধাপে ধাপে অন্যান্য সরকারি মানসিক হাসপাতালেও এই ব্যবস্থা চালু হবে বলে ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেখানে মনোরোগীদের পৃথক অস্তিত্বই কার্যত স্বীকার করা হয় না বেশির ভাগ জায়গায়, সেখানে তাঁদের জন্য এমন লকারের ব্যবস্থা কেন?
স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, মনোরোগীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে এ হল প্রথম ধাপ। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘নিজের জিনিস— এই উপলব্ধিটা ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। আমরা সেটাই চালু করতে চেয়েছি। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে যেটা উল্লেখযোগ্য তা হল, রোগিণীদের নগ্ন করে রাখার জন্য যে হাসপাতাল খবরের শিরোনামে এসেছিল, এ বার সেখানেই রোগিণীরা নিজেদের পোশাক, সাজগোজের জিনিস, ‘সম্পত্তি’ রাখার জায়গা পাচ্ছেন।’’
আরও পড়ুন: হেলমেট জরুরি, অন্য প্রচার শহরে
পাভলভ সূত্রে খবর, মেল ও ফিমেল ওয়ার্ডের রোগীদের যেটুকু জিনিসপত্র থাকে, তা তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে নিজেদের বুকে আঁকড়ে ঘুরে বেড়ান। বহু সময়েই সেই সব জিনিস চুরি হয়ে যায়। রোগীদের বিছানায়, এমনকী শরীরেও উকুনে বাসা বাঁধে। উকুন দূর করতে সেই সব জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে নিজেদের সম্বল বলতে তাঁদের আর কিছু থাকে না। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এই হারানোর বোধ ক্রমশ তাঁদের আরও একা করে দেয়। আরও গভীর অবসাদে তলিয়ে যেতে থাকেন অনেকে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য দফতরের এই সিদ্ধান্ত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
পাভলভের ওয়ার্ডে এখন ঝকঝকে স্টিলের লকার। প্রত্যেকটির গায়ে মালিকের নাম লেখা আছে। প্রত্যেকটি লকারই তালা বন্ধ। চাবির জিম্মা মালিকেরই। হাসপাতালের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘ওই চাবিই এখন ওঁদের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব। সব সময়ে চাবি নিয়ে ঘুরছেন। এমনকী ঘুমোনোর সময়েও চাবি ওঁদের কাছে থাকে। এক মুহূর্ত হাতছাড়া হয় না। ওঁরা এখন দায়িত্ব নিতে শিখছেন।’’
মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে স্বাস্থ্য দফতর এই ব্যবস্থা চালু করেছে, তাদের কর্ণধার রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘বিষয়টি শুধু একটা লকার হিসেবে দেখলে চলবে না। এক জন মনোরোগীর যখন এক এক করে সব ধরনের মানবাধিকার হারিয়ে যেতে থাকে, তখন তাঁদের কাছে এটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার অন্যতম একটা ধাপ।’’
পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদ জানিয়েছেন, সেরে ওঠা যে রোগীরা বছরের পর বছর বাড়ি ফেরার সুযোগ পাচ্ছেন না। প্রথম ধাপে তাঁদের এই লকার দেওয়া হচ্ছে। এর পরে ধাপে ধাপে সকলকেই দেওয়া হবে।
কলকাতা ছাড়া বহরমপুর এবং পুরুলিয়াতেও সরকারি মানসিক হাসপাতাল রয়েছে। সেখানেও এই ধরনের লকার ব্যবস্থা চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর।
এখনও পর্যন্ত পাভলভে যাঁরা লকার পেয়েছেন, কী রাখছেন তাঁরা? হাসপাতালের অন্দরে কান পেতে শোনা গিয়েছে অনেক গল্প। যেমন, এক রোগী হাসপাতালে ভর্তির সময়ে তাঁর সঙ্গে ছেলেবেলার একটি পোশাক নিয়ে এসেছিলেন। তিনি সেটাই সযত্নে রেখে দিয়েছেন। আর এক জন রেখেছেন তাঁর সন্তানের চিঠি। যে সন্তান তাঁকে হাসপাতালে রেখে আর খোঁজ নিতে আসেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy