বন্ধন: মেয়ে শ্রীনিকার সঙ্গে মা পারমিতা মজুমদার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
চার দিক খাঁ খাঁ করছে। মাঝেমধ্যে অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন লকডাউনে শুনশান রাস্তার ঘুম ভাঙাচ্ছে। এমনই এক সময়ে হাসপাতালের প্রতীক্ষালয়ে বসেছিলেন তরুণী মা। কিছু ক্ষণ আগে, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁর ছ’মাসের মেয়েকে। শূন্য প্রতীক্ষালয়ে বসে তরুণী ভেবেছিলেন, ‘ও সুস্থ হবেই।’ ঠিক বছর আড়াই পরের এক শারদপ্রাতে তরুণী ভাবছেন, সে দিন এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ওই জোর কোথায় পেয়েছিলেন?
আকাশে-বাতাসে দেবীর আগমন-বার্তা স্পষ্ট। পাড়ার মণ্ডপের কাজ শেষ পর্যায়ে। সে দিনের সেই মেয়েকে নিয়ে আজ পুজোর আনন্দে মেতে পরিবার। কিন্তু ২০২০ সালের ভয়াবহ দিনগুলো বলতে গিয়ে গলা বুজে আসছিল পারমিতা মজুমদারের। বললেন, ‘‘ছোট্ট মেয়েটা অনেক লড়েছে। আমি আর কীকরেছি! ভগবান আমায় শক্তি জুগিয়েছেন।’’ ওই বছরেরই ৩ জুন, পারমিতার যকৃতের অংশ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তাঁর রুপুর শরীরে। তার কয়েক মাস আগে ১১ নভেম্বর রুপুর জন্ম দেন পারমিতা। ভাল নাম শ্রীনিকা। আর পাঁচ জনের মতোই জন্ডিস ধরা পড়ে সদ্যোজাতের। কয়েক দিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরলেও, প্রস্রাব গাঢ় হলুদ হতে থাকে। সমস্যা বাড়লে মার্চে স্থানীয় এক চিকিৎসক দেখালে কিছু পরীক্ষা করতে দেন তিনি।
তত দিনে দেশে আছড়ে পড়ছে অতিমারির ঢেউ। ২৩ মার্চ প্রথম জনতা কার্ফুর বিকেলে জীবন মজুমদার নাতনির রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে আসেন। পারমিতা দেখেন, বিলিরুবিনের মাত্রা ২৩। রাতেই একরত্তিকে আলিপুরের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসক জানিয়ে দেন, যকৃৎ প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় নেই। অন্ধকার নেমে এলেও হাল ছাড়তে নারাজ মা। ভর্তি করা হয় এসএসকেএমে। সেখানে সাত দিন থাকার সময়ে শ্রীনিকার পেট ফুলে যাচ্ছিল। প্রস্রাবে বিছানা হলুদ হয়ে যেত।
হাসপাতালের বাইরে রাত কাটত বাবা সৌমিকের। আশার আলো না দেখে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। ওই এপ্রিলে শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয় শ্রীনিকা। ‘লিভার ফেলিওর’ হওয়ায় পেটে জল জমতে থাকে। তা বার করতে ফুটো করে নল লাগানো হয়েছিল। পারমিতা বলেন, ‘‘কচি শরীরে তত দিনে কয়েকশো বার সুচ ফোটানো হয়ে গিয়েছে। ওর কষ্ট দেখে ভাবতাম, আমি তা হলে কেন মন শক্ত করে লড়তে পারব না? পরিবারের সকলেই তো পাশে রয়েছেন।’’
এক রাতে আচমকাই শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় শ্রীনিকাকে ক্রিটিক্যাল কেয়ারে স্থানান্তরিত করা হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, দ্রুত যকৃৎ প্রতিস্থাপন করতে হবে। অবশেষে দিদি ও এক চিকিৎসকের মাধ্যমে দিল্লির এক হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তবে কম করে ন’লক্ষ টাকা এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া জোগাড় করা সম্ভব হয়নি পরিবারের। ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জেদ বেড়ে যেত।
টানা দেড় মাস ঘরবন্দি থেকে সেই বছর ২৬ মে স্পেশ্যাল ট্রেনে চেপে গোটা পরিবার পাড়ি দেয় দিল্লি। সেখানে একরত্তির পাশাপাশি সৌমিক ও পারমিতারও বিভিন্ন পরীক্ষা হয়। সন্তানকে নতুন জীবন দিতে তাঁর যকৃৎ কাজে লাগবে জেনে আশা জাগে পারমিতার মনে। ৩ জুন প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে চলে অস্ত্রোপচার। পারমিতা বলেন, ‘‘ও আমার একমাত্র সন্তান। সিজ়ারের সময়ে খুব ভয় পেয়েছিলাম। যকৃৎ অস্ত্রোপচারের সময়ে শুধু মনে হয়েছিল, মেয়েটা সুস্থ হবে।’’ ওই সন্ধ্যায় মেয়েকে পা নাড়তে দেখে কেঁদে ফেলেন মা। প্রতিদিন দিল্লির হাসপাতালে পৌঁছে সিসি ক্যামেরায় মেয়েকে দেখতেন পারমিতা-সৌমিক।
শ্রীনিকাকে কোলে নিয়ে পারমিতা জানান, ছুটির পরে মেয়েকে বুকে চেপে বিশ্বের সব সুখ উপলব্ধি করেছিলেন। ওই যুদ্ধ জয়ের আনন্দ ভুলিয়ে ছিল কোভিডের আতঙ্ক। ফেরার আগের রাতে মেয়ের জ্বর আসে। সে সব সামলে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন পারমিতারা।
কর্মসূত্রে অন্য জেলায় থাকেন সৌমিক। তাই ভোলুকে (পুতুল) কোলে নিয়ে মায়ের কাছেই এ বি সি ডি পড়ে রুপু। এ বার ভর্তি হবে নার্সারিতে। জন্মের পরে রুপুর এই পুজোই হবে প্রথম, যেখানে ও নতুন জামা পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেরোতে পারবে। এই প্রথম পুজোয় মন খুলে আনন্দ করবেন পারমিতা-সৌমিকও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy