Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

দেরিই ত্রাতা, আগুনে নগ্ন সরকারি কর্মসংস্কৃতি

যে কর্মসংস্কৃতির জন্য পশ্চিমবঙ্গের এত গঞ্জনা, সম্ভবত সেটাই হয়ে উঠল ত্রাতা! শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টা। সরকারি ভাবে তখন ‘অফিস টাইম’ শুরু হয়ে গেলেও বেশির ভাগ কর্মীই হাজির হননি। আচমকা নব মহাকরণের ‘এ’ ব্লকের আট তলায় আগুনের ফুলকি দেখে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়।

তখনও দাউদাউ করে জ্বলছে নব মহাকরণ। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।

তখনও দাউদাউ করে জ্বলছে নব মহাকরণ। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৮
Share: Save:

যে কর্মসংস্কৃতির জন্য পশ্চিমবঙ্গের এত গঞ্জনা, সম্ভবত সেটাই হয়ে উঠল ত্রাতা!

শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টা। সরকারি ভাবে তখন ‘অফিস টাইম’ শুরু হয়ে গেলেও বেশির ভাগ কর্মীই হাজির হননি। আচমকা নব মহাকরণের ‘এ’ ব্লকের আট তলায় আগুনের ফুলকি দেখে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দেখা যায়, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের (পিএইচই) মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ঘরের জানলা দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সঙ্গে লেলিহান আগুন। দেখতে দেখতে আরও কয়েকটি ঘর গ্রাস করে ফেলে আগুন। চোখের নিমেষে তা ছড়িয়ে পড়ে ছয় ও সাত তলায়। মিনিট পনেরো বাদে যখন দমকল আসে, তার মধ্যেই ভয়ে ওই সরকারি অফিস বাড়ি ছাড়তে শুরু করে দিয়েছেন কর্মীরা। প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন আয়ত্তে এলেও মন্ত্রী সুব্রতবাবুর ঘর ছাড়াও তাঁর সচিব এবং বিদুৎ দফতরের তিন আমলার ঘর কার্যত পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। তবে কোনও হতাহতের খবর নেই। কী ভাবে এটা হল?

অনেকেরই মত, সরকারি কর্মীরা ঠিক সময়ে অফিসে হাজিরা দিলে প্রাণহানি আটকানো কঠিন হয়ে পড়ত। নবান্নের এক কর্তা জানান, সরকারি অফিসে হাজিরার সময় সকাল ১০টা থেকে সোয়া ১০টা পর্যন্ত। সোয়া ১০টার পরে ‘লেট মার্ক’ পড়ে। সাড়ে ১০টার পর ঢুকলে তাঁকে সে দিন অনুপস্থিত বলে ধরা হয়। সরকারি সূত্রের খবর, নব মহাকরণের তিনটি ব্লক মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মী কাজ করেন। এ দিন আগুন যখন লাগে, তখন অফিসার-কর্মী মিলিয়ে দশ শতাংশও হাজির ছিলেন না। তাঁদের অনেকেরই মত— সময়ে হাজির না থাকাটাই শাপে বর হয়েছে। আগুন যে ভয়াবহ চেহারা নিয়েছিল তাতে ভরা অফিস থাকলে কী যে হত, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, বাম আমলে সরকারি অফিসে যে কর্মসংস্কৃতি দেখা গিয়েছে, রাজ্যে ক্ষমতা বদলের পর তা বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এ দিনের ঘটনা দেখিয়ে দিল, বদলায়নি কিছুই।

প্রাথমিক তদন্তের পর পূর্ত দফতর এবং দমকলের অনুমান, মন্ত্রীর ঘরে থাকা কম্পিউটারের ইউপিএস থেকেই প্রথমে আগুন লাগে। ঘরে প্রচুর কাঠের আসবার থাকায় দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্র। পূর্ত দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘খুব সম্ভবত সারা রাত ধরে ইউপিএস-টা চলছিল। কম্পিউটার যিনি বৃহস্পতিবার বন্ধ করেছেন, তিনি ইউপিএস বন্ধ করেননি। তার জেরেই এই বিপত্তি ঘটে গিয়েছে।’’ এ দিন বিকেলে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে এক প্রস্ত আলোচনা হয় নবান্নে পূর্ত সচিবের ঘরে। সেখানেই ঠিক হয়েছে, আজ শনিবার পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে দমকল ও পূর্ত অফিসারেরা নব মহাকরণ যাবেন। সরকারি সূত্রের খবর, আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করে নব মহাকরণে ফের অফিস চালু করতে আগামী বৃহস্পতিবার হয়ে যাবে। তবে শুধু ওই আট তলা নয়, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নব মহাকরণের তিনটি ব্লক (এ, বি, সি)-ই বন্ধ থাকবে। নব মহাকরণের আগুন লাগার পিছনে কোনও কারণ রয়েছে কি না, তা নিয়ে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগ এসি এআরএসের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে তদন্ত শুরু করবে। লালবাজার সূত্রের খবর, আগুন লাগার পিছনে অন্তর্ঘাত রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতেই এই কমিটি গঠন করা হচ্ছে।

আগুন লাগার খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে যান সুব্রতবাবু। তিনি এক বার সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার চেষ্টাও করেন। তবে ধোঁয়ার জন্য এক তলার বেশি এগোতে না পেরে ফিরে আসেন। জানান, সাধারণত তাঁর দফতরের কর্মীরা একটু দেরি করে অফিসে আসেন। তিনি নিজেও বেলার দিকে আসেন। ফলে এ দিন ঘটনার সময় তাঁর দফতরে প্রায় কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তবে বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, ‘‘প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ছিল দফতরের বিভিন্ন ঘরে। আগুনের পর তার কী অবশিষ্ট থাকবে তাই ভাবছি।’’ রাতে অবশ্য তিনি বলেন, ‘‘আমার ও সচিবের ঘরে আগুন লাগলেও কোনও নথি নষ্ট হয়নি। কারণ, সে সব ছিল দফতরের অন্য ঘরে।’’ তাঁর দফতর ও দমকল সূত্রের অবশ্য দাবি, বিধ্বংসী আগুনে মন্ত্রী ও আমলার ঘরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ ও ফাইল পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ দিন নব মহাকরণের আগুন প্রশাসনের মধ্যেই বেশ কয়েকটি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। নবান্নের এক কর্তা জানান, বহু টাকা খরচ করে নব মহাকরণের তিনটি ব্লকের অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা আধুনিক করে তোলা হয়েছে। কিন্তু আগুন লাগলে দ্রুত তা আয়ত্তে আনার জন্য প্রশিক্ষিত লোকবল এবং অন্যান্য ব্যবস্থা যে নেই, এ দিনের ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। প্রতিবেশী স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার নিজস্ব দমকল বাহিনী যদি প্রথমে আগুন নেভানোর কাজে হাত না লাগাত, তা হলে ছবিটা আরও ভয়ের হতে পারত। তাঁর কথায়, স্টেট ব্যাঙ্কের দমকল ব্যবস্থা এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছে এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা অনেক বেশি পেশাদার। পূর্ত দফতরের এক কর্তার অভিযোগ, বিভিন্ন মন্ত্রী ও আমলার ঘর যে ভাবে কাঠের আসবাব ও দাহ্য সামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে— তা আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। নবান্নের এক কর্তা জানান, কর্মীরা দেরিতে আসায় ওই বাড়িতে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম সময় মতো কাজে লাগানো যায়নি।

১ নম্বর হেস্টিংস স্ট্রিটে নিউ সেক্রেটারিয়েট ভবনে এ, বি ও সি— এই তিনটি ব্লকে রয়েছে বহু সরকারি দফতর। সেখান থেকে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাশে বিদ্যুৎ দফতরের একটি অফিসে। দফায় দফায় ২৫টি দমকলের ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে যায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। নব মহাকরণের মতো ঘিঞ্জি অফিস বাড়িতে আগুন নিমেষে ভয়াবহ আকার নিতে পারে বুঝে মিনিট পনেরোর মধ্যে সেখানে পৌঁছে যায় দমকল। দমকলের এক কর্তার কথায়, ‘‘আমরা জানতাম ওখানে আগুন নেভানোর সব ব্যবস্থাই রয়েছে। কিন্তু পূর্ত দফতরের সঙ্গে সঠিক সমন্বয়ের অভাবে কাজ শুরু করতেই আধঘণ্টা চলে যায়।’’ আগুন আরও বেশি ছড়াতে না পারলেও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ বেগ পেতে হয় অফিসারদের। একাধিক বার চেষ্টা করেও ‘স্কাই ল্যাডার’ ঢুকতে পারেনি ভেতরে। এক দমকল কর্মীর কথায়, ‘‘উত্তর দিকের গেটটা আর একটু উঁচু হলে অনায়াসেই ওই মই-সহ গাড়িটি ভিতর ঢুকতে পারত।’’ মাটি খুঁড়েও গাড়ি ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনও সুবিধে হয়নি। মাঝে এক বার জল সঙ্কটের মুখেও পড়তে হয়েছিল কর্মীদের। তখন ভবনের নিজস্ব জলাধার ব্যবহার করেন তাঁরা। প্রচণ্ড তাপে জানলার কাচ ভেঙে পড়তে থাকে নিচে। দমকল সূত্রে জানানো হয়, তাঁদের এক জন কর্মী এ দিন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ঘটনাস্থলে বিশাল বাহিনী নিয়ে পৌঁছন কলকাতা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারা। ঘটনাস্থলে হাজির হন
দমকল মন্ত্রী জাভেদ খান, জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়।

স্থানীয় দোকানদারেরা জানান, এ দিন আগুন লাগার পর কালো ধোঁয়া গোটা চত্বরে ছড়িয়ে পড়লে পাশেই সিটি সিভিল কোর্ট এবং হাইকোর্টের কর্তব্যরত পুলিশ এবং আম জনতা মুখে রুমাল চেপে ছুটোছুটি শুরু করেন। আইনজীবীরা বিভিন্ন বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। কাজকর্ম লাটে উঠে যায়। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ পুলিশকর্মীরা পুরো ভবনটি বড় টর্চ নিয়ে ঘুরে দেখেন। সঙ্গে দমকল এবং পূর্ত দফতরের আধিকারিকরাও ছিলেন। নেমে এসে এক পুলিশকর্মী বলেন, ‘‘আট তলায় এত গরম যে যাওয়া যাচ্ছে না। চোখ জ্বালা করছে, গা চুলকোচ্ছে।’’ জানা যায়, ওই তলাতেই আট–দশটি ঘর সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে। বড় বড় এলইডি টিভি পুড়ে ছাই, এসি কেবল লাইন বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রতিটি তলা জলে জলময়। সন্ধ্যার দিকে সি ব্লকে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ এবং বি-তে রাত পর্যন্ত অন্ধকারই ছিল।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE