বাঁধভাঙা: কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তারকা-দর্শনে মানুষের উন্মাদনা। রবিবার, নন্দনে। ছবি:সুদীপ্ত ভৌমিক
যা হওয়ার ছিল, সেটাই ঘটল। রবিবার সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসদনের পাশের ‘একতারা’ মুক্তমঞ্চে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল ‘সোশাল ডিস্ট্যান্সিং’-এর বিধিনিষেধ। মঞ্চে ডিজিটাল মাধ্যম ও সিনেমা নিয়ে আলোচনায় আবীর চট্টোপাধ্যায়, মাঠ ভিড়ে-ভিড়াক্কার। ‘বক্স অফিস’ লেখা অস্থায়ী তোরণ পেরোতে পেরোতে এক তরুণ তাঁর বন্ধুদের বললেন, ‘হালটা দেখেছিস’?
কার্নিভ্যালে অবশ্য এ রকম হাল হয়েই থাকে। মুক্তমঞ্চের সামনে ‘মছলিবাবা’-র কাঠামোর সামনে নিজস্বী তোলার ভিড়, সুবেশা তরুণীরা নন্দনের সামনে আলোময় নিজস্বী-প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে, তাঁদের পুরুষ-বন্ধু বা স্বামীদের হাতের মোবাইল ক্যামেরা মুহুর্মুহু ঝলকাচ্ছে। বাংলা আকাদেমিতে ঢোকার মুখে সিনে সেন্ট্রাল ও দু’টি সিনেমা-সংগঠনের পত্রপত্রিকার ভিড়হীন স্টল। এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক এক গোছা সরু পত্রিকা নিয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেন, ‘‘সরস গল্প। নেবেন দাদা? দশ টাকা।’’ গাছতলায় বসা এক তরুণী কান থেকে মোবাইল নামিয়ে পাশের ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘বাপি ফোন করছে। নন্দনে আছি বলব?’’ তরুণের উত্তর, ‘‘বলো, আমরা এগোচ্ছি।’’
এই ভিড় যে সিনেমা দেখার ভিড়, এমন নয়। কথা বলে বোঝা গেল, উৎসব উপলক্ষে অনেকেই রবিবারের বিকেলে ঘুরতে এসেছেন। এটাই শহরের জনসংস্কৃতি। সরকারি ‘হরিণঘাটা মিট’ এ বারই প্রথম ফিল্মোৎসবে রকমারি কাটলেট, ফিশ ফিঙ্গার, ফিশ ফ্রাইয়ের সম্ভার নিয়ে স্টল দিয়েছে। লকডাউনের সময়ে কলকাতার অনেক পাড়ার মাংস পছন্দকারীরা এই সংস্থার স্টলের ভরসায় থাকতেন। বেনফিশের বদলে হরিণঘাটার উপস্থিতি এ বারের উৎসবে হতে পারে লকডাউন এফেক্ট! ওই স্টলের নয়ন ঘোষ অবশ্য ‘‘সে রকম বিক্রি নেই’’ বলে আফশোস করছিলেন। ভিড় এখানে শুধু নিজস্বী তোলে, গাছতলায় গল্প করে আর কাগজের কাপে চা-কফি খায়। ‘বুক মাই শো’-তে উৎসবের টিকিটের আজই ছিল শেষ দিন, কিন্তু তাতেও খুব সাড়া ছিল বলে মনে হল না। রবিবার সাড়ে তিনটেয় নন্দনে ইউক্রেনের ছবি দেখতে ঢুকে দেখা গেল, আশানুরূপ ভাবেই হল ভর্তি হয়নি। অন্য সময়ে নন্দনের কাউন্টার থেকে রোজকার যে পাস দেওয়া হত, এ বার তা বন্ধ। গেস্ট কার্ড এবং ডেলিগেট কার্ডই ছবি দেখার একমাত্র ভরসা।
যদি কার্ডহীন আমজনতার কেউ বিশেষ কোনও ছবি দেখতে চান?
উৎসব-কমিটির সদস্য, সিনেমাটোগ্রাফার প্রেমেন্দুবিকাশ চাকী আশ্বস্ত করলেন, ‘‘ডেলি পাস আর ক’টা দেওয়া হত? এ বার ফেলিনি দেখার জন্যও নন্দনে ভিড় ছিল। কিন্তু সেখানে কার্ড না থাকলেও হেল্প ডেস্কের লোকেরা নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। সিনেমা দেখতে এসে লোকে ফিরে গিয়েছেন, এমনটা ঘটেনি।’’
ঘটার কথাও নয়। কারণ বেশির ভাগ লোকেই এখানে সরকারি কার্নিভ্যাল দেখতে আসেন, সিনেমা নয়। একদা উৎসবে আনসেন্সর্ড ছবির বাছাই দৃশ্য দেখার জন্য লাইন নন্দন থেকে তথ্যকেন্দ্র অবধি ছাপিয়ে যেত। এখন সকলের হাতে হাতে মোবাইল। ‘হায় আনসেন্সর্ড নীল ছবি, তোমার দিন গিয়াছে’!
রবিবার সকালে দক্ষিণ কলকাতার চলচ্চিত্র শতবর্ষ ভবনে ইজ়রায়েলের পরিচালক আমোস গিতাইয়ের ‘লায়লা অন হাইফা’ দেখতে গিয়ে দেখা গেল, কোভিড-বিধি মেনে অর্ধেক চেয়ার বন্ধ, বাকি চেয়ারে বয়স্ক কিছু ফিল্ম বাফ। নয়ের দশকে গিতাই কবে কলকাতায় এসেছিলেন, তাঁর সামনেই নন্দনের প্রোজেক্টর কী রকম বিগড়ে গিয়েছিল, এ সব নিয়ে তাঁরা আলোচনা করছিলেন। এই বাড়িতেই ‘পথের পাঁচালী’ শুটিংয়ের সময়ে সত্যজিৎ রায়ের ব্যবহৃত মিচেল ক্যামেরা রাখা। কিন্তু জনাকয়েক ফিল্ম অনুরাগী ছাড়া কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়?
শতবর্ষ ভবন, একদা রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োর এই বাড়িতে তরুণ মজুমদারের একটি অফিস ছিল। স্থানীয় এক চায়ের দোকানির কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘‘উৎসবে তো লোক আসছে। বিক্রিবাটাও হচ্ছে নিশ্চয়?’’ তিনি নস্যাৎ করে জানালেন, ‘‘বিক্রি কোথায়? বাঙুর হাসপাতাল তো এখনও কোভিড হাসপাতাল। ফলে আমাদের বিক্রিবাটাও মার খেয়েছে।’’ জনতার সংস্কৃতিতে যে কত ছোট ছোট সুখ-দুঃখের সুতো মিলেমিশে যায়!
জনসংস্কৃতির আর এক দিকচিহ্ন নন্দনের পুকুরপাড়। প্রেমের নন্দনকানন হিসেবে ওই জায়গাটা বিখ্যাত। রবিবার বিকেলে সেখানে গাছতলায় বসে আনমনে চুলের লকস ঠিক করছিলেন এক তরুণী, পাশে তাঁর গালে হাত বুলিয়ে আদর করছেন এক তরুণ।
সিনেমা শুধু পর্দায় থাকে না। জীবনের প্রতি সেকেন্ডের প্রতি ফ্রেমে সে ২৪ বার সত্য হয়ে ওঠে! তখন প্রেমই সত্য, কোভিড-আতঙ্ক নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy