পুনর্মিলন: মায়ের সঙ্গে দীপক জোশী। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
চার দশক পার করে শৈশবের স্মৃতিকে ছুঁলেন দীপক জোশী। পূর্ব নেপালের ঝাপা জেলার লুম্বক গ্রামে একতলা কাঠের বাড়িটার সামনে রবিবার সকাল থেকেই ভিড় ছিল পড়শিদের। যখন সবে দুপুর গড়িয়েছে, তখনই নেপাল দূতাবাসের আধিকারিকেরা দীপককে নিয়ে পৌঁছন তাঁর মায়ের কাছে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পরে নবতিপর মায়ের মুখোমুখি তাঁর আদরের দুর্গাপ্রসাদ (দীপকের ডাকনাম)।
১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে সেনাবাহিনীর চাকরির খোঁজে দার্জিলিং যাচ্ছেন বলে মাকে জানিয়েছিলেন দীপক। সেই শেষ দেখা। তার পরে আর ছেলের খোঁজ পাননি ধনোমায়া তিমসিনা। পাঁচ বছর অপেক্ষার পরে কেউ যখন কোনও খোঁজ দিতে পারেননি, তখন তাঁর দুর্গাপ্রসাদ মারা গিয়েছে, এমনটাই মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। পুজোর আসনের পাশে ছেলের একটা ছোট ছবি রেখে তার আত্মার শান্তি কামনায় এত দিন ফুল, মালা আর ধূপ দিয়েছেন।
নেপালের হ্যাম রেডিয়ো অপারেটরেরা জানান, যে দিন প্রথম বৃদ্ধা শোনেন যে দীপক বেঁচে আছেন এবং তাঁকে নেপালে ফেরানোর চেষ্টা চলছে, সে দিন বিশ্বাস করতে পারেননি। এ দিন ছেলেকে সামনে দেখেও কিছু ক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ধনোমায়াদেবী। তার পরে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। দীপকও বহু বছর পরে প্রথম বার আবেগের প্রকাশ করলেন কান্নাভেজা চোখে মাকে জড়িয়ে ধরে। মাকে রসগোল্লাও খাওয়ালেন। দেখা করতে আসা ছোটবেলার দুই বন্ধুর সঙ্গেও এ দিন কথা বলেন বছর পঁচাত্তরের দীপক। লাইভ ভিডিয়োয় পুরো ঘটনার সাক্ষী থাকলেন দীপকের মুক্তির জন্য যাঁদের অবদান সব চেয়ে বেশি, সেই ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবের সদস্যেরা। রেডিয়ো ক্লাবের সেক্রেটারি অম্বরীশ নাগবিশ্বাস বলেন, ‘‘অনেক হারিয়ে যাওয়া মানুষকে বাড়ি ফিরিয়েছি এত দিন। দীপক একটা নতুন কাজ দেখিয়ে দিয়ে গেলেন। ওঁর মতো বিনা বিচারে আটকে থাকা বন্দিদের খুঁজে বার করব এ বার। আদালতের সামনে তুলে ধরব তাঁদের কথাও।’’
দীপকের মুক্তির পরে বিচার ও আইন ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীদেরই একাংশ। আদালতের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮০ সালে চার্জশিট ফাইলের সময়ে দীপককে সম্পূর্ণ সুস্থ হিসেবেই দেখানো হয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। কিন্তু পরের বছর দায়রা আদালতে মামলা শুরু হওয়ার পরেই সরকারি আইনজীবী জানান, দীপক মানসিক ভাবে সুস্থ নন। তার পরের ৩৯ বছরেও কেন তিনি অসুস্থ বা তাঁকে সুস্থ কী ভাবে করা যায়, তা নিয়ে কোনও পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল রিপোর্টই পেশ করা হয়নি আদালতের কাছে। অন্য দিকে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গৌতম রায় বলেন, ‘‘১৯৮০ সালে সুনীল বাটরা (দ্বিতীয়) বনাম দিল্লি প্রশাসনের একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজ কারাগার পরিদর্শন করবেন, জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, অভিযোগ শুনবেন এবং উপযুক্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’’ কিন্তু তার কতটুকু বাস্তবে হয়? সেই প্রশ্ন ফের তুলছে দীপকের ৪০ বছর বিচারাধীন বন্দি হয়ে থাকার ঘটনা। গৌতমবাবুর দাবি, ‘‘এই ঘটনা বিচার ব্যবস্থা ও আইন ব্যবস্থার গলদটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।’’
‘প্রিজ়ন স্ট্যাটিস্টিকস রিপোর্ট ২০১৩’-র খতিয়ান অনুযায়ী, দেশের সংশোধনাগারগুলিতে মোট বন্দির ৬৭.৬ শতাংশই বিচারাধীন। পাঁচ বছর বা তারও বেশি সময় বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা সে সময়েই ছিল ৩০৪৭ জন। এই রেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী বলেই জানিয়েছেন কারা বিভাগের আধিকারিকেরাও। তথ্য বলছে, জেলগুলির পরিকাঠামোর তুলনায় বন্দির সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় আদালত এবং বিচারকের সংখ্যা কম। ফলে প্রায় প্রতিটি মামলারই গতি রোধ হচ্ছে। আইনজীবীরাও জানাচ্ছেন, মূলত সমন্বয় এবং সদিচ্ছার অভাবেই ঝুলে থাকছে মামলাগুলি। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সুস্থ মানুষকে সাত দিন বিনা বিচারে আটকে রাখলেই যে সে অপ্রকৃতিস্থ হবে, তার জন্য কোনও মনোবিদের ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আর এ ক্ষেত্রে কেটে গিয়েছে ৪০ বছর।’’ তিনি জানান, কখনও সাক্ষী নেই, কখনও ময়না-তদন্তের ডাক্তার ছুটিতে, কখনও তদন্তকারী অফিসার বদলি হয়েছেন— এমন নানা কারণে মামলার দিন পিছিয়ে যায়। পরিবার তদ্বির না করলে বিচারাধীন মানুষগুলির হয়ে কথা বলারও কেউ নেই। তাই এমন অসংখ্য দীপক হয়তো এখনও বিচারাধীন। বিচারের অপেক্ষা করতে করতে হয়তো অভিব্যক্তি হারিয়ে গিয়েছে তাঁদেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy