রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের কোনও কাহিনির আস্ত একটি পাতা যেন উঠে এল বিকেলের শিয়ালদহ স্টেশনে!
৯বি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে রাজধানী এক্সপ্রেস। ওই ট্রেনের পাশ দিয়ে একটি বাক্স হাতে হেঁটে যাচ্ছেন ছিপছিপে চেহারার এক যুবক। অন্য এক যুবক হাঁটছেন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে। বাক্সটি নিয়ে তাঁরা সোজা উঠে গেলেন এসি টু-টিয়ারের একটি কামরায়। অন্য ব্যাগপত্র যথারীতি ঢুকিয়ে দিলেন বার্থের তলায়। কিন্তু কাঠের বাক্সটি হাতছাড়া করলেন না। সেটি বগলদাবা করেই ঠায় বসে রইলেন ওই যুবক। এমনকী রাতে যখন শুতে গেলেন, বাক্স রইল তাঁর সঙ্গেই।
কে ওই যুবক? কেনই বা তিনি ট্রেনে উঠেও কাঠের বাক্স বগলদাবা করে বসে রইলেন রাতভর? কী এমন মহামূল্যবান বস্তু রয়েছে ওই বাক্সে?
পুলিশি সূত্রের খবর, ছিপছিপে চেহারার ওই যুবকের নাম রাজকুমার মিশ্র। শেক্সপিয়র সরণি থানার সাব-ইনস্পেক্টর। আর তাঁর সঙ্গী মহীতোষ মণ্ডল ওই থানারই কনস্টেবল। এবং যে-বাক্সটিকে তাঁরা ভুলেও কাছছাড়া করছিলেন না, তাতে রয়েছে ওই থানা এলাকার ৩ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের বাড়িতে পাওয়া কঙ্কালের করোটি। কঙ্কালটি ওই বাড়ির মেয়ে দেবযানী দে-র কি না, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কঙ্কালের করোটি এবং দেবযানীর ছবি সোমবার পাঠানো হল চণ্ডীগড়ের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে। সেখানে ওই করোটির সুপার ইম্পোজিশন ফরেন্সিক পরীক্ষা হবে। আজ, মঙ্গলবার সকালে দিল্লি পৌঁছবেন রাজকুমার-সহ শেক্সপিয়র সরণি থানার দুই কর্মী। সন্ধ্যায় সেখান থেকে তাঁরা রওনা হবেন চণ্ডীগড়।
গত ১০ জুন রবিনসন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে অরবিন্দ দে নামে এক বৃদ্ধের অগ্নিদগ্ধ দেহ উদ্ধার করা হয়। পরের দিন ওই বাড়ির একটি ঘরে একটি মানুষের এবং দু’টি কুকুরের কঙ্কাল মেলে। অরবিন্দবাবুর ছেলে পার্থ পুলিশকে জানান, কঙ্কালটি তাঁর দিদি দেবযানীর। ঘটনার পর থেকে পার্থ পাভলভ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ওই বাড়ি থেকে একটি ক্যামেরা উদ্ধার করেন তদন্তকারীরা। তাতে ২০১০ সালের বড়দিনে তোলা দেবযানীর ছবি মিলেছে। সেগুলি শেক্সপিয়র সরণি থানার কর্মীদের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশের খবর।
সুপার ইম্পোজিশন ফরেন্সিক পরীক্ষাটি আসলে কী?
পুলিশ ও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা জানান, কোনও কঙ্কাল ঠিক কার, সাধারণ ব্যবস্থায় তা শনাক্ত করতে না-পারলে এই পরীক্ষা করা হয়। এক কালে কঙ্কাল থেকে প্লাস্টার অব প্যারিসের ছাঁচ তৈরি করে তা দিয়ে মুখের পুনর্গঠন করা হত। কম্পিউটারের দৌলতে পদ্ধতি বদলেছে। এখন বিভিন্ন কোণ থেকে কঙ্কালের করোটির ছবি তোলা হয়। যাঁর কঙ্কাল বলে মনে করা হচ্ছে, তাঁর ছবির সঙ্গে করোটির সেই ছবি মিলিয়ে দেখা হয় কম্পিউটারের বিশেষ সফটওয়্যারে। ছবি থেকে যেমন করোটির আকার বেরোয়, একই ভাবে করোটির বিভিন্ন জায়গা ভরাট করে বার করা হয় মুখের আদল। রাজ্য ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির এক প্রাক্তন কর্তা জানান, ছবি থেকে পাওয়া করোটি এবং করোটি থেকে পুনর্গঠিত মুখ বিভিন্ন ভাবে মিলিয়ে দেখা হয়। ‘‘তবে ডিএনএ পরীক্ষা এই পরীক্ষার থেকেও উন্নততর পদ্ধতি,’’ বলছেন প্রাক্তন ওই ফরেন্সিক-কর্তা।
দেবযানীর ছবির নেগেটিভ তৈরি করে তা থেকে বার করা হবে করোটির আদল। সেটির সঙ্গে রবিনসন স্ট্রিটে পাওয়া কঙ্কালের করোটির অন্তত ১১টি বিষয় মিলিয়ে দেখা হবে। করোটির ছবিতেও মুখের আদল দেওয়া হবে কম্পিউটারের সাহায্যে। কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘১৫ দিনের মধ্যে যাতে সুপার ইম্পোজিশনের রিপোর্ট পাওয়া যায়, তার চেষ্টা চলছে।’’
রবিনসন স্ট্রিটের ওই বাড়ির কর্তা অরবিন্দবাবুর দেহ রাখা আছে এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গে। পুলিশ জানিয়েছে, ডিএনএ পরীক্ষার কাজ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত সেটির সৎকার করা যাবে না। শেষকৃত্যের জন্য দেহটি কাকে দেওয়া হবে, সেই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন তদন্তকারীদের একাংশ। পুলিশ বলছে, অরবিন্দবাবুর দেহ সৎকারের প্রথম দায়িত্ব ছেলে পার্থেরই। কিন্তু পার্থ চিকিৎসকদের বলেছেন, রীতি মেনে সৎকারে তাঁর বিশ্বাস নেই। তবে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, সম্প্রতি হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে বাবার মৃতদেহের ব্যাপারে এক বার খোঁজখবর নিয়েছেন তিনি। দেহ সৎকারের আগে দক্ষিণেশ্বরের যোগদা সৎসঙ্গ আশ্রমের সঙ্গে (তাঁর বাবা, দিদি এবং তিনি যে-আশ্রমের শিষ্য ছিলেন বলে পার্থের দাবি) কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন পার্থ।
পুলিশের বক্তব্য, পার্থ তাঁর বাবার দেহ নিতে চান বা না-চান, সেটা তাঁকে লিখিত ভাবে জানাতে হবে। তিনি মৌখিক বয়ান দিলে হাসপাতালের কোনও চিকিৎসককে সাক্ষী রেখে পুলিশের তরফে তা নথিভুক্ত করা হবে। পার্থ যদি বাবার দেহের দায়িত্ব নিতে না-চান, সে-ক্ষেত্রে অরবিন্দবাবুর ভাই অরুণ দে-কে সেটি গ্রহণ করতে বলবে পুলিশ। তিনি প্রত্যাখ্যান করলে সেটাও জানাতে হবে লিখিত ভাবে।
ছেলে বা ভাই, কেউই যদি দেহটি নিতে না-চান?
‘‘ছেলে বা ভাই, কেউই যদি শেষ পর্যন্ত অরবিন্দবাবুর দেহ নিতে না-চান, সে-ক্ষেত্রে দেহটি বেওয়ারিশ হিসেবে ধরে নিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে,’’ বললেন এক পুলিশকর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy