Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

‘খাম’-বন্দি নেশার ডাক বিকোচ্ছে শহরে

দশটার জায়গায় ওই যুবক এলেন প্রায় পৌনে বারোটা নাগাদ। দেখেই মুখে হাসি ফুটল ক্রেতাদের। বিক্রেতার ট্রাউজার্সের সাতটি পকেট থেকে বেরোল লাল, কালো আর ছোট ছোট প্রচুর ‘খাম’।

সাঙ্কেতিক: ‘লাল খাম’ (বাঁ দিকে) ও ‘কালো খাম’ (ডান দিকে) নামে বিক্রি হয় গাঁজার পুরিয়া। নিজস্ব চিত্র

সাঙ্কেতিক: ‘লাল খাম’ (বাঁ দিকে) ও ‘কালো খাম’ (ডান দিকে) নামে বিক্রি হয় গাঁজার পুরিয়া। নিজস্ব চিত্র

আর্যভট্ট খান
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:১১
Share: Save:

অন্যান্য দিন তো সকাল দশটার মধ্যে চলে আসেন। আজ তা হলে এখনও আসছেন না কেন? যাঁরা তাঁর কাছ থেকে লাল বা কালো ‘খাম’ কিনতে আসেন, তাঁরা তখন রীতিমতো অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। ফোনে যে অর্ডার দেবেন, তারও উপায় নেই। কারণ, বিক্রেতা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মোবাইলে অর্ডার নেওয়া বন্ধ। কারণ, ‘মাল’ হোম ডেলিভারি দিতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন এক বার। শ্রীঘরে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।

দশটার জায়গায় ওই যুবক এলেন প্রায় পৌনে বারোটা নাগাদ। দেখেই মুখে হাসি ফুটল ক্রেতাদের। বিক্রেতার ট্রাউজার্সের সাতটি পকেট থেকে বেরোল লাল, কালো আর ছোট ছোট প্রচুর ‘খাম’।

ঘটনাস্থল, রাজারহাটের ডিরোজিও কলেজের কাছে লোকনাথ বাজার। ‘খাম’ আসলে এক সাঙ্কেতিক ভাষা। যার অর্থ গাঁজার পুরিয়া। সূত্রের খবর, শুধু রাজারহাটের ওই কলেজের কাছেই নয়, গোটা শহর জুড়েই এ ভাবে গাঁজার বিভিন্ন পুরিয়া বিক্রি চলছে অবাধে। এবং লেনদেনে ব্যবহৃত হচ্ছে ওই সাঙ্কেতিক ভাষা। কোথাও বাজারের কোনও দোকানে, কোথাও রেল স্টেশনের আশপাশে, কোথাও আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি হচ্ছে গাঁজা। কোনও কোনও বিক্রেতা আবার অর্ডার পেলে বাড়িতেও গাঁজা পৌঁছে দিচ্ছেন। কলকাতা পুলিশের নার্কোটিক্স শাখার এক কর্তার দাবি, ‘‘সম্প্রতি ই এম বাইপাস এলাকায় একটি গাড়ি থেকে প্রচুর পরিমাণ গাঁজা উদ্ধার হয়। প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাই। তবে প্রকাশ্যে গাঁজা বিক্রি আগের থেকে অনেক কমেছে।’’

পুলিশ এমন দাবি করলেও সামগ্রিক ছবিটা কি বদলাচ্ছে? প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। রাজারহাটের ডিরোজিও কলেজের কাছে ওই চা-সিগারেটের দোকানের সামনে সকাল দশটা থেকেই শুরু হয়ে যায় গাঁজা বিক্রি। অভিযোগ, ওই কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে এলাকার বিভিন্ন বহুতলের বাসিন্দারাও সেই গাঁজার খদ্দের। সারা দিন রাস্তার উপরে প্রকাশ্যেই চলে গাঁজা বিক্রি। দোহারা চেহারার বিক্রেতা জানালেন, কলেজ চলাকালীনই ‘খাম’ বিক্রি হয় সব চেয়ে বেশি। রবিবার খাম বিক্রি বন্ধ থাকে। তবে ছুটির আগের দিন অবশ্য বিক্রি ভাল হয়। কারণ, অনেকেই ওই দিনটির জন্য গাঁজা মজুত করে রাখেন।

তিনি জানান, লাল ও কালো খামের মধ্যে বিক্রি বেশি লালের। কারণ, ওটাই সব চেয়ে উৎকৃষ্ট মানের গাঁজা। বড় লাল খামের দাম ১২০ টাকা ও ছোট লাল খামের দাম ৬০ টাকা। কোনও দরাদরি চলবে না। বড় কালো খামের দাম ৮০ টাকা। ছোটটি ৪০ টাকা। ট্রাউজার্সের পিছনের পকেট থেকে মাঝারি আকারের একটি প্যাকেট বার করে বিক্রেতা বললেন, ‘‘১২০ টাকার পুরিয়া, যা লাল খাম নামে বিক্রি হয়, তার মান সব থেকে ভাল। লাল খামের দম লা-জবাব।’’ সেই সঙ্গেই অবশ্য পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, আশপাশে অনেক বহুতল হওয়ায় এখন লাল খামের বিক্রি খুব ভাল।

লাল ও কালো খামের মধ্যে পার্থক্য কী? খদ্দেরদের মতে, লাল খামের নেশা কালো খামের চেয়ে বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়। তবে যে কোনও মানের গাঁজাই কিন্তু শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, গাঁজা খেলে মস্তিষ্ক ও শরীর— দু’টিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাইকায়াট্রি বিভাগের প্রধান গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গাঁজা খেলে ফুসফুসের ক্ষতি থেকে শুরু করে নানা রকম সমস্যা হয়। নিয়মিত গাঁজা সেবনে ঘুম কমে যাওয়া, অবসাদ, সন্দেহবাতিক, অকারণে চিৎকার-চেঁচামেচি করার মতো নানা উপসর্গ দেখা দেয়।’’ ওই চিকিৎসকের মতে, ‘‘নিয়মিত গাঁজা খেলে তা জমা হয় মানুষের মস্তিকের নানা অংশে। বেশি দিন গাঁজা খেলে ‌কেউ উন্মাদও হয়ে যেতে পারেন।’’ চিকিৎসকদের মতে, দীর্ঘদিন গাঁজা খেলে মানুষের মধ্যে ‘ক্রনিক অ্যামোটিভেশনাল সিনড্রোম’ তৈরি হয়, যা খুবই মারাত্মক। এর ফলে এক জন মানুষের যে কোনও ধরনের কাজ করার উৎসাহ কমতে থাকে।

কলকাতা পুলিশের কর্তাদের মতো বিধাননগর কমিশনারেটের কর্তাদেরও দাবি, গাঁজার বিরুদ্ধে অভিযান চলছে গোটা বিধাননগর জুড়েই। ওই কমিশনারেটের ডি সি (সদর) অমিত জাভালগি বলেন, “বহু ঠেক ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমাদের এলাকায় যেখানে গাঁজা বিক্রি চলছে বলে অভিযোগ, স্থানীয় থানাকে বলে দ্রুত সেই দোকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

আর ডিরোজিও কলেজের অধ্যক্ষ দিব্যেন্দু তলাপাত্র বলেন, ‘‘আমাদের কলেজে কোনও রকম নেশাদ্রব্য বরদাস্ত করা হয় না। সিসি ক্যামেরাও রয়েছে। নিয়মিত নজরদারি চলে। এমনকি, পান, গুটখা খাওয়ার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে কেউ যদি নেশা করে, তা হলে তার নজরদারি কী ভাবে করব?’’

অন্য বিষয়গুলি:

Marijuana Kolkata Dealer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE