উৎকণ্ঠায় বুক শুকিয়ে গিয়েছিল মধ্য কলকাতার বাসিন্দা, বছর পঞ্চান্নর প্রৌঢ়ার। সারা রাত হাসপাতালে জাগার পরে সকালের দিকে চেয়ারে বসতেই চোখটা লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ তুমুল ঝনঝন শব্দে কেঁপে উঠল হাসপাতালের সামনের দিকটা। কান ফাটানো আওয়াজে ভাঙছে পরপর চেয়ার-টেবিল-কম্পিউটার। বাধা দিতে গিয়ে বেধড়ক মার খাচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষীরা।
সঙ্গে সঙ্গে প্রৌঢ়ার মনে পড়েছিল, হাসপাতালের উপরের তলায় আইসিইউ-এর শয্যায় থাকা স্বামীর কথা। ওঁর কোনও ক্ষতি হবে না তো! তা হয়নি ঠিকই, কিন্তু ওই পঁয়তাল্লিশ মিনিটের তাণ্ডব ভুলতে পারছেন না প্রৌঢ়া। তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালে এক কিশোরীর মৃত্যুকে ঘিরে কিছু গোলমাল ভোর থেকেই কানে আসছিল। কিন্তু তা যে ওই রকম আকার ধারণ করবে, তা ভাবতেও পারিনি।’’ অত তাণ্ডবের মধ্যেও সিএমআরআই হাসপাতালের কর্তারা অবশ্য আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন, রোগীদের কোনও ক্ষতি হবে না।
কিন্তু একটা মৃত্যু নিয়ে এত রাগ কেন সাধারণের? মৃত্যু নিঃসন্দেহে শোকের, কিন্তু তা এমন হিংসার জন্ম দেবে কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সারা হাসপাতাল চত্বরেই প্রায় একই রকম ক্ষোভের মুখোমুখি হতে হল। এ দিনের তাণ্ডবের তীব্র নিন্দা করে, উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেও কমবেশি সকলেই বলছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি দায় এড়াতে পারেন না। পরিষেবার বিনিময়ে রোগীর পরিবারকে সন্তুষ্ট করার দিকে বেশ পিছিয়েই রয়েছে এই হাসপাতাল। গাফিলতির অভিযোগও প্রায়ই ওঠে এখানে। সেই সঙ্গে বিপুল অর্থ খরচের অভিযোগও রয়েছে।
এ বিষয়ে মুখ খুললেন ওই প্রৌঢ়াও। স্বামীর জন্য উৎকণ্ঠা উপচে গলায় ফুটে উঠল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। হৃদ্রোগ নিয়ে গত সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রৌঢ়ার স্বামী। এই ক’দিনেই জলের মতো টাকা বেরিয়ে গিয়েছে। অথচ, ঠিক কতটা গভীরে সমস্যা, তা স্পষ্ট করে বলছেন না চিকিৎসকেরা। সব রকম পরীক্ষা করা হচ্ছে কি না, হলেও তার রিপোর্ট কী— সে বিষয়েও স্পষ্ট নয় হাসপাতালের অবস্থান।
বস্তুত, সিএমআরআই-এর চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে মানুষের অভিযোগ নতুন নয়। স্থানীয় এক যুবক সাতসকালে ভাঙচুরের খবর পেয়েই ছুটে এসেছেন সিএমআরআই-তে। তাঁর মা ভর্তি রয়েছেন অর্থোপেডিক বিভাগে। ‘‘টিভিতে ভাঙচুরের ছবি দেখে তো ভাবলাম, মায়েরই না কিছু হয়ে যায়! যারা ভিতরে ঢুকে ওই ভাবে তাণ্ডব করতে পারে, তারা তো যে কোনও জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে। রোগীরাও তো বিপদে!’’ — বললেন সন্ত্রস্ত যুবক। তবে হাসপাতালে এসে সবটা শোনার পরে কর্তৃপক্ষের আচরণে খানিকটা অবাকই হয়েছেন তিনি। রোগীর পরিবারকে অন্ধকারে রাখা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তাঁরও। বললেন, ‘‘মাকে নিয়ে এসেও একই রকম ভুগেছি। কতটা অসুখ, কত দিনের চিকিৎসা প্রয়োজন, স্পষ্ট করে বলতেই চাননি চিকিৎসকেরা। বরং কর্তৃপক্ষের বেশি খেয়াল ছিল, মায়ের মেডিক্লেম আছে কি না, তা নিয়ে।’’
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ইন্দ্রাণী বসু। গত মাসের ২৯ তারিখে ইউরোসেপসিসের সমস্যা নিয়ে তাঁর বৃদ্ধ বাবা স্বপন রক্ষিতকে সিএমআরআই-তে ভর্তি করেছেন ইন্দ্রাণী। আজ ছাড়া পাওয়ার কথা। এই ক’দিনে বিল হয়েছে সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা। ইন্দ্রাণীর সাফ বক্তব্য, ‘‘চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ অর্থ এখানে নেওয়া হয়, তার বিনিময়ে পর্যাপ্ত পরিষেবা মোটেই মেলে না’’ ইন্দ্রাণীর অভিযোগ, তাঁর বাবার স্বাস্থ্য-বিমা রয়েছে জানতে পেরেই যথেচ্ছ বিল ধরিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তিনি আরও জানান, চিকিৎসক নেই, এই অজুহাতে একটা সামান্য পরীক্ষা করাতেও বেশ কয়েক দিন দেরি করা হয়। এক লিটার জলও এখানে তিরিশ টাকা দিয়ে কিনে খেতে হয় বলে অভিযোগ তাঁর। তেমনই চড়া খাবারের দাম। হাসপাতালের মেডিসিন স্টোরেও অধিকাংশ সময়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ পাননি তিনি।
তবে এ সব কিছুর পরেও এ দিন হাসপাতালে যা ঘটল, তার তীব্র নিন্দা করেছেন ইন্দ্রাণী। বললেন, ‘‘হাসপাতালে তো আরও রোগী আছেন, তাঁদের কথা মাথায় রেখে সংযত থাকা উচিত ছিল মৃত কিশোরীর পরিবারের। চোখের সামনে এ রকম তাণ্ডব দেখে সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম। এত ভয় আগে কখনও পাইনি। হাসপাতালের মতো সংবেদনশীল জায়গায় এমন সন্ত্রাস কাম্য নয়।’’
ভাঙচুরের নিন্দায় একমত হলেও অভিযোগগুলি অবশ্য সবই উড়িয়ে দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে আসছেন তাঁরা। এমন অভিযোগ কখনও ওঠেনি। এ দিনের ঘটনার পিছনে পূর্বের কোনও ইতিহাস নেই। নিছকই বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy