সরকারি হাসপাতালে ওষুধের জন্য হাপিত্যেশ ক্রমেই বাড়ছে ক্যানসার রোগীদের। প্রতীকি ছবি
প্রেসক্রিপশন হাতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরছিলেন এক প্রৌঢ়। এসএসকেএম হাসপাতাল চত্বরেই দিন পাঁচেক ধরে তিনি পড়ে আছেন মেয়েকে নিয়ে। ডিম্বাশয়ে (ওভারিয়ান) ক্যানসারের ওই রোগীর অস্ত্রোপচার-পরবর্তী কেমোথেরাপি চলছে। তৃতীয় বারের কেমো নিতে এসেই বিপত্তি। যে ওষুধ চলছিল, তা নিতে নির্দিষ্ট দিনে হাসপাতালে এসেও পাওয়া যায়নি। নদিয়ার বাসিন্দা ওই রোগী তাই হাসপাতাল চত্বরেই থাকছেন। কারণ, ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, ওষুধ যে কোনও দিন আসতে পারে।
গত কয়েক মাস ধরে সরকারি হাসপাতালে ওষুধের জন্য এমন হাপিত্যেশ ক্রমেই বাড়ছে ক্যানসার রোগীদের। শুধু এসএসকেএমের নয়, নীলরতন সরকার, আর জি কর এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগীদেরও এই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ। যার ফলে ভেঙে যাচ্ছে কেমোথেরাপির শৃঙ্খল (প্রতিটি ক্যানসারের ক্ষেত্রে কেমোর ডোজ়ের যে ব্যবধান নির্দিষ্ট করা থাকে)। আক্রান্তের শরীরে নতুন করে ছড়াচ্ছে রোগ।
সরকারি হাসপাতালে ক্যানসারের ওষুধ হয় ক্যাটালগ আইটেম (ক্যাট) ও নন-ক্যাটালগ আইটেমের। ‘ক্যাট’ অন্তর্ভুক্ত ওষুধ পাওয়া যায় হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের দোকানে, বা সরকার দরপত্র ডেকে তা আনে। আর ‘লোকাল পারচেজ়’ হয় নন-ক্যাটালগ আইটেমের। ক্যানসার চিকিৎসায় সিংহভাগই ‘ওরাল কেমোথেরাপি’। বাকিটা ‘সিস্টেমিক কেমোথেরাপি’, যা সাধারণত আইভি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। ক্যাটের তালিকাভুক্ত এই দুই প্রকার ওষুধের মধ্যে বেশি সমস্যা ‘সিস্টেমিক কেমোথেরাপি’ নিয়ে।
আর জি করের এক চিকিৎসক জানাচ্ছেন, দিনকয়েক আগে এক রোগীর কেমোথেরাপির ওষুধ হাসপাতালে ছিল না। ওই চিকিৎসকের কথায়, “সৌভাগ্যের বিষয় যে, ওই ওষুধের দাম ১৯২ টাকা। প্রথম বার হাজার টাকার মতো খরচ হবে। তাঁকে কেমোথেরাপি ছ’টি ডোজ়ে নিতে হবে। আশা করব, এর পরেরগুলো তিনি হাসপাতালেই পেয়ে যাবেন।”
এন আর এসের এক চিকিৎসকের দাবি, এই সমস্যা কোভিড-পরবর্তী সময়ে অনেকটাই বেড়েছে। আগে অসুবিধা হত না। অনেক ভেবেচিন্তে ওষুধ লিখেও কিছু দিন পরে তা স্টকে থাকছে না। অন্য এক চিকিৎসকের কথায়, “প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধের বাইরে কিছু দেওয়া যায় না। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধ না পেলে রোগ ছড়াতে শুরু করবেই। এই আশঙ্কা বেশি স্তন ক্যানসার, লিভার ক্যানসার, কোলন বা মলদ্বারের ক্যানসারের রোগীদের ক্ষেত্রে।”
ভুক্তভোগীদের একাংশের অভিযোগ, ক্যানসার রোগীদের এত বড় সমস্যায় কার্যত তাপ-উত্তাপহীন সরকারি হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধানদের একটি অংশ। এমন সমস্যার অস্তিত্বের কথা উড়িয়েই দিলেন এন আর এসের ক্যানসার বিভাগের প্রধান শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল। তাঁর কথায়, “আমাদের হাসপাতালে সব ওষুধই ঠিক মতো পাওয়া যায়। কোনও রকম অসুবিধাই নেই।” যা শুনে ফুঁসে উঠলেন ভাঙড়ের সফিকুল ইসলাম। বাবার কোলন ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপির চতুর্থ ডোজ় পাননি। সফিকুল বলেন, “উনি অনেক বড় ডাক্তার। ছোট বিষয়ের খবর রাখেন না। ডাক্তারবাবুরাই তো বলে দেন যে, নির্দিষ্ট দিনে ওষুধ না পেলে ডে কেয়ারে প্রতিদিন ফোন করে খোঁজ করতে। যে দিন আছে বলবে, সে দিনই এসে নিয়ে যেতে হবে! আমি কি তবে আট দিন ধরে মজা করতে ফোন করছি?”
এসএসকেএমের ক্যানসার বিভাগের প্রধান অলোক ঘোষ দস্তিদারের কথায়, “এই অভাব ক্যানসারের যে কোনও সিস্টেমিক কেমোথেরাপির ক্ষেত্রে বেশি। স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে ২১ দিন অন্তর কেমোথেরাপি দিতে হয়। বহু ক্ষেত্রে এই ব্যবধান মানা যাচ্ছে না। লাইপোজ়োমাল ডক্সোরুবিসিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ পেতেও নাজেহাল হতে হচ্ছে। ডিম্বাশয়, স্তন এবং ফুসফুসের সেকেন্ড লাইন ক্যানসারে এটি ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসক হিসাবে এই অসহায়তার মুখোমুখি সাত-আট মাস আগেও এতটা হতে হয়নি।”
কেন এমন হচ্ছে? রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘দরপত্র ডেকে সরকার ওষুধের নির্দিষ্ট দাম ঠিক করে এই ব্যবস্থা চালু রাখে। দরপত্রের মেয়াদ দু’-তিন বছর পর্যন্ত থাকে। শেষ দরপত্র ডাকা হয়েছিল সম্ভবত ২০১৭ সালে। এখন তাই পুরনো দরে ভেন্ডার ওষুধ দিতে চাইছে না। ফলে এই সমস্যা হচ্ছে। নতুন করে দরপত্র ডাকা হয়ে গিয়েছে। ১০-১৫ দিনের মধ্যে এই সমস্যা মিটে যাবে বলে আশা করছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy