এই ফ্ল্যাট থেকেই উদ্ধার হয়েছে তিনটি কঙ্কাল-সহ অগ্নিদগ্ধ দেহ। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী।
এ যেন হিচককের সাইকো! খাস কলকাতায়!
শেক্সপিয়র সরণি থানার রবিনসন স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাট থেকে এক মহিলা এবং দু’টি পোষ্য কুকুরের কঙ্কাল উদ্ধারের ঘটনায় কলকাতা পুলিশ মহলে ঠিক এই কথাটাই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ছ’মাস ধরে ওই মৃত মহিলাকে ‘খাওয়ানো’ হয়েছে। তাঁর আত্মা যে ওই বাড়িতেই ঘোরাঘুরি করছে, এমন আবহ সৃষ্টি করার জন্য গোটা ফ্ল্যাট জুড়ে লাগানো হয়েছে সাউন্ড সিস্টেম। এর সঙ্গেই ওই ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ওই মহিলার বাবার অগ্নিদগ্ধ দেহ। স্মরণকালের মধ্যে এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা মনে করতে পারছেন না কলকাতা পুলিশের অফিসাররা। এই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে মহিলার ভাইকে। মনস্তত্ববিদেরা এই ঘটনাকে ‘সাইকোলজিক্যাল কেস’ হিসাবেই দেখছেন। ওই মহিলা ও তাঁর দুই পোষ্যের দেহ ধীরে ধীরে কঙ্কালে পরিণত হওয়ার সময়েও পড়শি বা স্থানীয় বাসিন্দারা কেউ কোনও গন্ধ পেলেন না কেন, তা নিয়েও রহস্য দানা বেঁধেছে। প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসছে আরও নানা প্রশ্ন।
পুলিশ সূত্রের খবর, বুধবার রাতে রবিনসন স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাটের জানলা থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখে স্থানীয়েরা পুলিশে খবর দেন। দমকলকর্ম়ীদের সঙ্গে নিয়ে পুলিশ ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে শৌচাগারের বাথটব থেকে অরবিন্দ দে (৭৭) নামে এক বৃদ্ধের মৃতদেহ উদ্ধার করে। অরবিন্দবাবু পেশায় বি টেক ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরে ওই ফ্ল্যাট থেকেই কাপড় জড়ানো অবস্থায় তিনটি কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। সন্দেহ হওয়ায় অরবিন্দবাবুর ছেলে পার্থকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, কঙ্কাল তিনটি তাঁর দিদি দেবযানী দে এবং বাড়ির দুই পোষ্য কুকুরের। কুকুরগুলি গত বছরের অগাস্টে মারা যায়। তার পর থেকেই খাওয়াদাওয়া ত্যাগ করেছিলেন পেশায় গানের শিক্ষিকা তাঁর দিদি। ৬ মাস আগে অপুষ্টিজনিত কারণে মারা যান বছর সাতচল্লিশের দেবযানী। এর পরেও শেষকৃত্য না করে দেবযানীর মৃতদেহের সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটেই বসবাস করছিলেন অরবিন্দবাবু ও তাঁর ছেলে পার্থ। রোজ রাতে দিদির মৃতদেহকে ‘খাওয়াতেন’ পার্থ। এমনকী, দিদির আত্মা তাঁদের সঙ্গেই রয়েছে এমন আবহ সৃষ্টি করার জন্য গোটা বাড়ি জুড়ে লাগানো হয়েছে সাউন্ড সিস্টেম। সেখান দিয়েই নানা ধরনের ‘ভৌতিক’ আওয়াজ শোনা যেত বলে পুলিশ জানাচ্ছে।
অরবিন্দবাবুর মেয়ে দেবযানী।
বৃদ্ধের দেহটি উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পরে ওই বাড়ির সামনে দু’জন পুলিশকর্মীকে প্রহরায় রাখা হয়েছিল। তার পরেই ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। দুই পুলিশকর্মীকে বাইরে বসে থাকতে দেখে পার্থ কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। পুলিশ জানিয়েছে, ওই যুবক দেওয়ালে ঘুষি মেরে, চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে দুই কনস্টেবল ফের থানায় খবর দেন। পুলিশ ওই যুবককে থানায় নিয়ে যায়। তার পরেই জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশকে ওই যুবক জানায়, বাড়িতে তিনটি কঙ্কাল রয়েছে। সেগুলির একটি তাঁর দিদির, বাকি দুটি বাড়ির পোষ্যের। দেবযানীর কঙ্কালটি শোয়ানো ছিল খাটের উপরে। সেখানে শুয়ে থাকতেন পার্থও। এই যুবক কাজ করতেন একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায়। পুলিশ জানিয়েছে, বেশ কিছু দিন ধরে তিনি আর অফিসে যেতেন না। বাড়িতেই থাকতেন।
পুলিশ সূত্রে খবর, জেরায় পার্থ জানিয়েছেন, তাঁর দিদি যে মারা গিয়েছেন তা তিনি মানেন না। সেই কারণেই তিনি তাঁর দিদির মৃত্যুর পরে দেহটি কাপড় দিয়ে জড়িয়ে খাটে শুইয়ে রেখেছিলেন। তাঁকে রোজ খাবার দিতেন। এমনকী, বাড়ির পোষ্য দু’টি কুকুরের কঙ্কালও বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন।
পুলিশ জানিয়েছে, ২০১৪-র অগস্টে কিছু দিনের ব্যবধানে বাড়ির দু’টি কুকুরের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার মাস কয়েক পরেই মৃত্যু হয় দেবযানীর। তিনি অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। উপবাসেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশকে পার্থ জানান। শুধুমাত্র, মৃতা দিদিকে তিনি খাওয়াতেনই না, বাড়িতে তাঁর উপস্থিতি যাতে উপলব্ধি করা যায় সেই কারণে পেন ড্রাইভের মাধ্যমে পার্থবাবু বিভিন্ন কন্ঠস্বর স্টোর করে রেখেছিলেন। সেগুলি বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় থাকা ‘সাউন্ড সিস্টেম’- এর মাধ্যমে শুনতেন যাতে তিনি অনুভব করতে পারেন যে বাড়িতে তাঁর দিদি রয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, তিনটি কঙ্কালের এবং বৃদ্ধের ফরেন্সিক ও ময়নাতদন্ত হবে। তখনই বোঝা যাবে কখন কার মৃত্যু হয়েছে এবং মৃত্যুর কারণ কী? পাশাপাশি, পার্থবাবু কী ভাবে মৃতদেহগুলির সঙ্গে থাকতেন সে ব্যাপারেও জানতে পুলিশ চিকিৎসকদের সাহায্য চেয়েছে।
এই সংক্রান্ত আরও:
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy