বৌদ্ধ স্তূপের সেই ভাঙা অংশ। — নিজস্ব চিত্র।
কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে এ বার ক্ষতিগ্রস্ত হল খ্রিস্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতকের বৌদ্ধ স্তূপ। জাদুঘরের গান্ধার গ্যালারির মাঝখানে কাচের বাক্সে ঢাকা ছিল নাতিউচ্চ এই স্তূপটি।
জাদুঘর সূত্রের খবর, সোমবার সকালে স্তূপটির নীচে থাকা সিলিকা জেল সরিয়ে তা নতুন করে রাখতে গিয়ে কাচটি ভেঙে স্তূপের উপর পড়ে। তবে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায় এড়াতে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের নিযুক্ত ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন’ (এনবিসিসি)-এর উপর দায় চাপিয়েছেন। জাদুঘরের মিডিয়া মুখপাত্র অশোক ত্রিপাঠী জানান, ২৫-৩০ বছর আগে থেকেই স্তূপটির ক্ষয়ের মাত্রা বাড়ছিল। তাই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ মাঝেমধ্যে কাচের বাক্সের ভিতরে সিলিকা জেল দেওয়ার কথা বলে গিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ মেনেই এ দিন সিলিকা জেল রাখতে গিয়ে স্তূপটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর আরও দাবি, এ দিনের স্তূপের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পিছনে জাদুঘরের কোনও কর্মী দায়ী নন। এই ঘটনার জন্য দায়ী এনবিসিসি-র লোকজনের গাফিলতিই। কারণ কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের নিযুক্ত এনবিসিসি-কে এই সব কাজের দায়িত্ব দেওয়া হলেও, তাঁরা কোনও বিশেষজ্ঞ না নিয়েই এই কাজগুলি করে। এনবিসিসি-র এক কর্তা অবশ্য দাবি করেন, জাদুঘরের সংস্কারের দায়িত্ব তাঁদের দেওয়া হলেও কোনও পুরাবস্তুতে তাঁরা হাত দিতে পারেন না। কিন্তু জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এনবিসিসি কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই তাঁদের নিচুতলার কর্মীদের দিয়ে অনেক সময় পুরাবস্তু সরানোর কাজ করিয়ে নেন। তবে এ দিন তাঁদের কোনও কর্মী ওই স্তূপে হাত দেননি বলে ওই কর্তা দাবি করেছেন।
মাস দুই আগেই জাদুঘরে ভারহুতের একটি যক্ষ মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই যক্ষ মূর্তিটি ভারহুত থেকে কলকাতায় আনেন আলেকজান্ডার কানিংহাম। কানিংহামই সুদূর গান্ধার থেকে নিয়ে এসেছিলেন এই স্তূপটিও। এটি একটি নিবেদন স্তূপ, যা বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। কিন্তু শুধু তা-ই নয়, ইতিহাসবিদ ও পুরাতত্ত্ববিদেরা জানাচ্ছেন, স্তূপকে বৌদ্ধ ধর্মের স্থাপত্য, শিল্প ও ভাস্কর্যের মূল বীজ বলেও মনে করা হয়।
তথাগতের প্রিয় উপস্থাপক বা সেবক ছিলেন আনন্দ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের ঐশ্বর্য বিশ্বাস জানান, দীঘনিকায়ের মহাপরিনিব্বান সূত্র থেকে জানা যায়, আনন্দ তথাগতকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দেহাবসান বা পরিনির্বাণের পরে তাঁর শরীর পূজার বিধান কী হবে? তখন তথাগত প্রথমে তাঁকে বারবার নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন। পরে দ্বিতীয় পন্থা হিসেবে তথাগত আনন্দকে বলেছিলেন, ‘চক্রবর্তী রাজাগণের মতোই দেহ ভস্মীভূত হলে দেহাবশেষ সংগ্রহ করে চতুর্মহাপথে স্তূপ নির্মাণ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পার।’ যে কারণে স্তূপ বৌদ্ধ ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন মহা নির্দেশক গৌতম সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘স্তূপের আকৃতিটি বুদ্বুদের মতো। যা জীবনের নশ্বরতার প্রতীক। বৌদ্ধ ধর্মের একটি ভিত্তি হচ্ছে স্তূপ।’’ তিনি জানান, বুদ্ধের জীবনাবসানের পরে তাঁর দেহাবশেষ প্রথমে সে সময়ের প্রধান জনগোষ্ঠীগুলি যেমন শাক্য, কোলীয়দের কাছে পাঠানো হয়। তাঁরা স্তূপ নির্মাণ করে তা সংরক্ষণ করেন। স্তূপই বুদ্ধের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। সেগুলি ছিল মাটির তৈরি স্তূপ। পরে সম্রাট অশোকের আমলে সেগুলিতে পাথরের বেষ্টনী দেওয়া হয়। গান্ধার অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই স্তূপ তৈরি করা শুরু হয়। সেগুলি প্রধানত কুষাণ যুগের অর্থাৎ খ্রিস্টীয় প্রথম দ্বিতীয় শতকের।
গান্ধারের এই স্তূপটি নরম সিস্ট পাথর দিয়ে তৈরি। কী ভাবে এই পুরাবস্তু এ বার জোড়া দেওয়া উচিত? সংরক্ষণবিদ পার্থ দাস বলেন, ‘‘এই পুরাবস্তুটি প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো। এ বার এটিকে রাবার সিলিকন আঠা বা এপোক্সি আঠা দিয়ে খুব সাবধানে জুড়তে হবে। বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানেই তা করা উচিত।’’ এটি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা লুকোনও উচিত নয়। রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের প্রকাশচন্দ্র মাইতি বলেন, ‘‘আঠা দিয়ে না জুড়ে স্তূপটি স্টিল, লোহার টুকরো বা ফাইবার দিয়েও ধরে রাখা যায়।’’
কী করে এ দিন স্তূপের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হল?
জাদুঘর সূত্রের খবর, এই স্তূপটিতে ক্ষয় ধরা পড়েছে বলে সম্প্রতি যক্ষ মূর্তি ভাঙার পরে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কলকাতা মণ্ডলের অধিকর্তা পি কে মিশ্রের নেতত্বে একটি দল জাদুঘরের কয়েকটি গ্যালারি পরিদর্শন করতে আসেন। তখনই গান্ধার গ্যালারিতে ঢুকে এই স্তূপের ক্ষয় তাঁদের চোখে ধরা পড়ে এবং পরে সেই রিপোর্টও তাঁরা সর্বেক্ষণের কেন্দ্রীয় দফতরে পাঠান। জাদুঘরের অধিকর্তাকেও সে কথা জানিয়েছিলেন তাঁরা।
জাদুঘর সূত্রের খবর, এই ধরনের পাথরের শিল্পকলার ক্ষয় রোধে সাধারণত সিলিকা জেল ব্যবহার করা হয়। সোমবার স্তূপের নীচে রাখা সেই সিলিকা জেল পাল্টাতে গিয়েই এই স্তূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে সূত্রের খবর।
সেই সিলিকা জেল পাল্টানোর জন্য যে ধরনের যত্ন এবং সুরক্ষার দরকার ছিল, তা এ দিন নেওয়া হয়নি বলে জাদুঘর কর্মীদের একাংশের অভিযোগ। তাঁরা জানাচ্ছেন, অধিকর্তা অনুমতি দিলেও নিরাপত্তা আধিকারিককে জানিয়ে এই ধরনের কাজ করা নিয়ম। কারণ তখন সেই গ্যালারিতে থাকা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার মুখ ওই শিল্পকলার দিকেই রাখা হয়। এই রেকর্ডটি রাখা জরুরি এবং জাদুঘরের শিল্পকলা সংরক্ষণ কী ভাবে করা হয়, তার স্বার্থেই করা নিয়ম। এ দিন অধিকর্তার অনুমতি থাকলেও, নিরাপত্তা আধিকারিককে জানানো হয়নি বলেই সূত্রের খবর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy