পুলিশি নিষেধ উড়িয়েই সাইকেল বাইপাসের চিংড়িঘাটায়।
সাইকেল ভাল নিঃসন্দেহে। কিন্তু কলকাতার পক্ষে তা কি উপযোগী? যে শহরে ফুটপাথ দখল হয়ে যাওয়ায় পথচারীদের রাস্তায় নেমে আসতে হয়, সেখানে সাইকেলের জন্য আলাদা লেন তৈরি করা আদৌ কতটা সম্ভব, সে প্রশ্ন তুলেছেন নগর পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। শুধু তা-ই নয়, সাইকেলের ভিড় বাড়লে তা শহরের গতি কমিয়ে দেয় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আগেও হয়েছে। সেটাই আবার নতুন করে শুরু হয়েছে আজ, রবিবার বিশ্ব সাইকেল দিবসের আগে।
নগর পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সাইকেল পরিবেশবান্ধব আর সস্তা হওয়ার কারণে বহু মানুষই প্রতিদিনের যাতায়াতের জন্য দূষণহীন এই যানের উপরে নির্ভরশীল। অনেকে সাইকেলে মালপত্রও বয়ে নিয়ে যান। কিন্তু তার পরেও কলকাতার রাস্তায় সাইকেল কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অতীতে ‘কলকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’র (কেএমডিএ) তরফে শহর ও সংলগ্ন এলাকার যানবাহন চলাচল নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল। ‘ট্র্যাফিক অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন মাস্টার প্ল্যান’ নামে ওই সমীক্ষা রিপোর্টে ডালহৌসি স্কোয়ার, শ্যামবাজার, হাজরা মোড়, ধর্মতলা-সহ শহরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের যানবাহন চলাচলের সামগ্রিক চিত্র তথ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছিল। শহর ও সংলগ্ন এলাকার যান চলাচলের ক্ষেত্রে ওই রিপোর্টকে এখনও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন অনেকে। কারণ, ক্রমশ পাল্টে যাওয়া শহরের যান-চিত্র কেমন হতে পারে ভবিষ্যতে, তার একটা আভাস দেওয়া হয়েছিল সেখানে। ওই রিপোর্টেও শহরের মূল রাস্তাগুলিতে সাইকেল-সহ কম গতির যানবাহনকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছিল।
কেএমডিএ-র ‘প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ দফতরের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল তুষার মিত্র বলেন, ‘‘কলকাতার মতো শহরে যেখানে বাস, ট্রাম, ট্যাক্সি-সহ অনেক রকম যান চলাচল করে, সেখানে সাইকেল চললে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। তা ছাড়া, রাস্তা পার হওয়ার জন্য সাইকেলকে বেশি সময় দিতে হবে। কারণ, রাস্তা পার হতে গাড়ির থেকে একটা সাইকেলে বেশি সময় লাগে। ফলে যানজটের আশঙ্কাও থাকছে।’’
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালেই কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের তরফে শহরের ৩৮টি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় সাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তা নিয়ে বিস্তর বিতর্কও হয়েছিল তখন। পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি রাস্তায় সাইকেল চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুলিশের যুক্তি ছিল, মূল রাস্তায় সাইকেল চললে দুর্ঘটনার পাশাপাশি যানবাহনের গতি রুদ্ধ হতে পারে। কলকাতা পুরসভার সড়ক দফতরের কর্তারাও তেমনটাই মনে করছেন। সড়ক দফতরের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘রাস্তা চওড়া হলেই সাইকেল চালানো যেতে পারে, এমন একটা ধারণা রয়েছে। ধর্মতলার রাস্তা তো অনেক চওড়া। কিন্তু প্রতি মিনিটে যানবাহনের পাশাপাশি এত সংখ্যক পথচারী সেখানে যাতায়াত করেন যে, সাইকেল চালানোর কথা ভাবাই যায় না! তা ছাড়া, হকার, দখলদার, সৌন্দর্যায়ন-সহ কলকাতার রাস্তার একাধিক সমস্যাও তো রয়েছে। সেখানে সাইকেলের জন্য আলাদা লেন কী ভাবে করা সম্ভব?’’
এ প্রসঙ্গে উঠে এসেছে শহরের গড় গতির প্রসঙ্গটিও। সাইকেল চলাচল যে শহরের সামগ্রিক গতির উপরেও একটা প্রভাব ফেলতে পারে, তেমনটাই মনে করছেন অনেকে। কলকাতা পুরসভার নগর পরিকল্পনা দফতরের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল দীপঙ্কর সিংহ বলেন, ‘‘একাধিক সমীক্ষা বলছে, দেশের অধিকাংশ মেট্রোপলিটান শহরে যানবাহনের গড় গতি যেখানে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার, সেখানে কলকাতায় গতি অনেকটাই কম। ঘণ্টায় ১৪-১৫ কিলোমিটার। ফলে ক্রমাগত শ্লথ হতে থাকা শহরের মূল রাস্তায় যদি আবার সাইকেল চলে, তা হলে গতি কমতে বাধ্য। ফলে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া সাইকেল চালানো হলে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হবে।’’ ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ (আইআইইএসটি)-র অধ্যাপক সুদীপ রায় বলেন, ‘‘সাইকেলের গতি কম। এখন নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যদি সাইকেল চালানো হয়, তা হলে তা অন্য যানবাহনের গতিকেও শ্লথ করে দেবে। শুধু মূল রাস্তাতেই নয়, রাস্তার মোড়গুলিতেও সাইকেলের নিজস্ব গতি অন্য যানবাহনের গতিকে শ্লথ করে দেবে। কোন কোন রাস্তা দিয়ে সাইকেল চলতে পারে বা আদৌ পারে কি না, তা আগে সমীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy