আয়ুষ চিকিৎসকদেরই কাজে লাগানো হচ্ছে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে। প্রতীকী ছবি।
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বা স্কুলে গিয়ে শিশুদের সাধারণ সর্দি-কাশি চিহ্নিত করলেও, ওষুধ দেওয়ার অধিকার নেই তাঁদের। কিন্তু সেই আয়ুষ চিকিৎসকদেরই কাজে লাগানো হচ্ছে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে অ্যালোপ্যাথির বিশেষজ্ঞ বা শল্য চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অথবা চিকিৎসার নথি পরীক্ষার কাজে!
মাসকয়েক আগে স্বাস্থ্য দফতর সিদ্ধান্ত নেয়, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের বিলে কারচুপি আটকাতে অডিট করা হবে। অর্থাৎ, বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের দেওয়া বিলের ৩০ শতাংশের ‘র্যান্ডম অডিট’ করে দেখা হবে, আদৌ সেই চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল কি না। সেই কাজে ২০০ জন চিকিৎসকের দলেই রাজ্যের কয়েকটি জেলায় যুক্ত করা হয়েছে আয়ুষ চিকিৎসকদের। যাঁরা সংশ্লিষ্ট জেলায় ‘আরবিএসকে’ (রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রম) প্রকল্পের মেডিক্যাল অফিসার পদে কর্মরত। কেন্দ্রের ওই প্রকল্পে ২০১৩ থেকে ধীরে ধীরে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় এই আয়ুষ চিকিৎসকদের নিয়োগ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে রাজ্যে আরবিএসকে-মেডিক্যাল অফিসার রয়েছেন প্রায় ১২০০ জন। তাঁরা ব্লক ও পুরসভায় কর্মরত।
জন্মগত ত্রুটি এবং ১৮ বছর পর্যন্ত যে সমস্ত অসুখ হয়, এমন যে ৪৪টি রোগের তালিকা রয়েছে, তাতে অঙ্গনওয়াড়ি বা স্কুলের কোনও শিশু আক্রান্ত কি না, সেটা চিহ্নিত করতে হয় আয়ুষচিকিৎসকদের। এক চিকিৎসকের কথায়, “কারও সর্দি-কাশি হয়েছে বলে মনে হলেও আমরা ওষুধ দিতে পারি না। রোগ চিহ্নিত করার পরে শিশুকে জেলা বা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হয়।” সেখানে নার্সিংহোমে চিকিৎসা করা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাঅস্ত্রোপচার করা শল্য চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন কী ভাবে তাঁরা খতিয়ে দেখতে পারেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আয়ুষ চিকিৎসদেরই একাংশ। অভিযোগ, বেশ কয়েকটি জেলায় রীতিমতো চাপ দিয়ে তাঁদের ওই কাজ করানো হচ্ছে।
বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকদের একাংশও। শহরের এক অভিজ্ঞ চিকিৎসকের কথায়, “দিন-দিন এখন চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে। যে বিভাগে যিনি বিশেষজ্ঞ, তিনি সেটি সব থেকে ভাল বোঝেন। সেখানে আয়ুষ চিকিৎসকদের এমন ভাবে ব্যবহার করার অর্থ বোধগম্য নয়।” যদিও স্বাস্থ্য ভবনের দাবি, ফিজ়িয়োলজি ও অ্যানাটমি বিষয়ে আয়ুষ চিকিৎসকদেরও পড়তে হয়। তাই তাঁদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সূত্রের খবর, রাজ্যে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার করে চিকিৎসা হচ্ছে। তার ৩০ শতাংশ, অর্থাৎ ২১০০টি করে বিল পরীক্ষার জন্য ৩০-৪০ জন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। সেখানে কাজের চাপ কম থাকায় আয়ুষ চিকিৎসকদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য-অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী বলেন, “ওঁরা প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষা করবেন। তাতে কোনও ত্রুটি রয়েছে মনে হলে, তা খতিয়ে দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা তো রয়েছেন।”
যদিও চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না থাকায় বিপদে পড়ে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে উপভোক্তা কমাতে নানা ফন্দি-ফিকির করছে স্বাস্থ্য দফতর। ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, “যে কোনও প্রকল্পের অডিট নিশ্চয়ই হওয়া উচিত। তাই বলে আধুনিক চিকিৎসার অডিট করবেন আয়ুষ ডাক্তারেরা? তা হলে কি ধরে নিতে হবে, স্বাস্থ্য প্রশাসনে কোনও বিশেষজ্ঞ নেই? না কি স্বাস্থ্য প্রশাসকদের উপরে সরকারের আস্থা নেই?” তিনি আরও বলেন, “আরবিএসকে প্রকল্পের স্ক্রিনিং আর স্বাস্থ্যসাথীর অডিট কি এক হল? বিপদে পড়ে পুরো প্রকল্প গুলিয়ে দিতে চাইছে সরকার।” আবার, বিষয়টিকে অবৈজ্ঞানিক দাবি করে ‘সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম’-এর সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাস বলেন, “দুঃখের হলেও সত্যি, অডিট দলে বিভিন্ন জায়গায় আয়ুষ চিকিৎসকদের কাজে লাগানো হচ্ছে। কেন্দ্র ক্রসপ্যাথি চালু করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। রাজ্য সরকারও তারই অনুকরণ করে এমন পদক্ষেপ করেছে। আয়ুষ চিকিৎসকদের দিয়ে অডিটের সিদ্ধান্ত আসলে লোকদেখানো।”
যদিও বিষয়টিকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বলে দাবি করে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্যের সম্পাদক, সাংসদ-চিকিৎসক শান্তনু সেন বলেন, “যে কোনও মাধ্যমেই চিকিৎসাবিদ্যায় পাশ করতে গেলে সাধারণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাই সেই জ্ঞান থাকলে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবুও আয়ুষ চিকিৎসকদের কোনও বক্তব্য থাকলে প্রশাসনকে জানাতে পারেন।” তবে, রাজ্যে যে ভাবে আয়ুষ চিকিৎসকদের ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিন্দনীয় বলে দাবি করে ‘অল বেঙ্গল হোমিয়োপ্যাথি ডক্টর্স ফোরাম’-এর চেয়ারম্যান মোহিত কাজি বলেন, “ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন এখন রাজ্যের হাতে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। সেখানে রাজ্য চাইলেই আয়ুষ চিকিৎসকদের ফার্মাকোলজির প্রশিক্ষণ দিয়ে মূল স্রোতে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু করছে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy