যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন প্রয়াত ছাত্র স্বপ্নদীপ কুন্ডুর সহপাঠী অর্পণ মাঝি। ছবি: ফেসবুক।
বুধবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেন হস্টেলে’ ঠিক কী হয়েছিল, তা এখনও অজানা। হস্টেলের বারান্দা থেকে বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রের পড়ে যাওয়ার ঘটনাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করছেন না তাঁর অধ্যাপকেরাও। ধীরে ধীরে উঠে আসছে র্যাগিংয়ের তত্ত্বও। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার যাদবপুরের ওই নিহত ছাত্রের এক সহপাঠী ফেসবুকে জানালেন তাঁর ‘বিভীষিকাময়’ অভিজ্ঞতার কথা। যাদবপুরের এই ছাত্রটি ওই মেন হস্টেলেরই বাসিন্দা। যার তিন তলার বারান্দার নীচে বুধবার রাত সাড়ে ১১টার সময় পাওয়া গিয়েছিল নিহত ছাত্র স্বপ্নদীপ কুন্ডুর রক্তাক্ত দেহ।
মেন হস্টেলের ওই ছাত্রের নাম অর্পণ মাঝি। তিনিও স্বপ্নদীপের মতোই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তবে বিভাগ আলাদা। স্বপ্নদীপ বাংলার ছাত্র ছিলেন। অর্পণ জিওলজি বিভাগের। ফেসবুকে নিজের পরিচয় দিয়ে অর্পণ লিখেছেন, ‘‘... আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমার পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা একটি পরিবার এবং আমি আসানসোলে বড় হয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই আমি ভর্তির সময় হস্টেলের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরুর পরের দু-তিন রাতেই হস্টেল আমার মধ্যে বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে। এখন আমি অনেক কষ্ট করেই, ধার নিয়ে হলেও মেস খুঁজছি।’’
কেন আর্থিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মেস খুঁজতে হচ্ছে তাঁকে? অর্পণের কথায়, ‘‘সমাজের প্রতিটি স্তরে ক্ষমতা প্রদর্শন আছে, কিন্তু যাদবপুর মেন হস্টেলের কিছু দাদাও যে এই একই কাজ করবে তা আমার কল্পনার অতীত। মাথায় একটি স্পেসিফিক ছাঁটের চুল কাটতে বলা, সন্ধে ৬টার মধ্যে হস্টেলে ঢোকার ফরমান, ক্রমাগত সিনিয়রদের ফাইফরমাশ খাটা, সারা রাত জাগিয়ে রেখে ‘ইন্ট্রো’ (শুনছি ‘আসল ইন্ট্রো’ নেওয়াই হয়নি এখনও ) নেওয়া। ওই তিন রাত ধরে এগুলো আমার সঙ্গে চলছে এবং আমিও ভয় পেয়েই রয়েছি।’’
অর্পণ জানিয়েছেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়েই তিনি এখানে পড়তে এসেছিলেন। ফেসবুকে সেই অনুভূতির কথা বিশদে জানিয়েওছেন তিনি। লিখেছেন, ‘‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছে সব থেকে লড়াকু একটি বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে প্রতিটি ছাত্রছাত্রী অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে, এরা প্রতিবাদের পথ দেখায়।’’ তবে স্বপ্নদীপের সহপাঠী একই সঙ্গে লিখেছেন, সমাজের সর্বত্র দুর্বলের উপর সবলের ক্ষমতা প্রদর্শনের যে ধারা, এখানে তার কোনও ব্যতিক্রম দেখেননি তিনি। যে ভাবে সংখ্যাগুরু মানুষ সংখ্যালঘুদের উপর, পুরুষেরা মহিলাদের উপর, উঁচু জাতের মানুষ নিচু জাতের উপর নির্দয় হন, সেই একই আচরণ তিনি যাদবপুরেও ‘ক্ষমতাবান সিনিয়র’দের (ইউনিয়ন নেতাদের মদতপুষ্ট) করতে দেখেছেন ‘জুনিয়র’দের প্রতি।
অর্পণের ওই ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করেছেন অনেকেই। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে বুধবার রাতে কোনও বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা হয়েছিল স্বপ্নদীপেরও? পুলিশের বয়ান বলছে, বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলের ‘এ’ ব্লকের তিন তলার বারান্দা থেকে ‘কোনও ভাবে’ পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে স্বপ্নদীপের। এই মৃত্যু আত্মহত্যা কি না সে ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি রিপোর্টে। তবে আত্মহত্যার জল্পনা উড়িয়ে দিয়েছে স্বপ্নদীপের পরিবার। মৃত ছাত্রের মা জানিয়েছেন বুধবার রাতে মাকে ফোন করেছিলেন স্বপ্নদীপ। আত্মহত্যার কোনও ইঙ্গিত মেলেনি তাঁর কথায়। বরং বাংলার প্রথম বর্ষের ছাত্র মাকে বলেছিলেন, তিনি ভাল নেই। তাঁর খুব ভয় করছে। মা যেন শীঘ্রই তাঁর কাছে আসেন। তাঁর অনেক কথা বলার আছে মাকে। তার পর কী হয়েছিল অবশ্য জানা যায়নি বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত। তবে স্বপ্নদীপের সহপাঠী অর্পণের কথায় ‘র্যাগিং’-এর তত্ত্বই আরও বেশি জোরালো হচ্ছে।
অর্পণ লিখেছেন, ‘‘যাদবপুরের মেন হস্টেল নিয়ে আমি অনেক গল্প শুনেছি। বন্যার্তদের সাহায্যের গল্প, কোয়ারেন্টাইনের সময় অসহায় মানুষের পাশে থাকার গল্প। যাদবপুর থানার নানা দাদাগিরির বিরুদ্ধে সারা দিন সারা রাতের ঘেরাওয়ের গল্প। আমি বিশ্বাস করি মেন হস্টেলের বেশির ভাগ দাদাই এই লড়াকু ঐতিহ্য বহন করেন। কিন্তু কয়েক জনের জন্য আমি আমার সহপাঠীকে হারালাম।’’
ফেসবুকে স্পষ্ট র্যাগিংয়ের কথা বলেই অর্পণ লিখেছেন, সহমর্মী দাদাদের কাছে তাঁর আবেদন, তাঁরা যেন র্যাগিংয়ের মতো ক্ষমতা প্রদর্শনকে সমূলে বিনাশ করার আন্দোলন করেন। ঠিক যে ভাবে আরও বহু অন্যায়ের প্রতিবাদে আন্দোলন করে এসেছেন তাঁরা এত দিন। অর্পণের কথায়, ‘‘অনুরোধ করব, দু-চারটি ভোটের জন্য ইউনিয়ন লিডারশিপ এই ক্ষমতাবানদের বাঁচিয়ে রাখার যে আপস করে, তারা যেন সেই পথ থেকে সরে আসে। না হলে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনও তফাত হয় না। তারাও ভোটব্যাঙ্ক বাঁচাতে অন্যায়কে বকলমে সমর্থন করে। আর এখানেও দুটো ‘ভোট ঘুরে যাবে’ বলে কিছু ক্ষমতা-ধর্ষকামীকে লালন করা হচ্ছে।’’ অর্পণ লিখেছেন, র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে তিনি ইউনিয়ন থেকে আজ অবধি কোনও প্রচার শোনেননি। বরং শুনেছেন, র্যাগিং হওয়ার পর ইউনিয়নের দাদারা আপস করে নিতে বলেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy