গল্পগুচ্ছ: শহরে বসেছে আড্ডার ক্লাস। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
আড্ডাও কেনা যায়। নাম লিখিয়ে জানানো যায়, ‘গল্পে আছি!’
থেরাপিস্টের কাছে গিয়ে মনের কথা বলে হাল্কা হওয়ার উপায় আগেই মিলেছে। এ বার সে ভাবেই কফি শপের আড্ডায় যোগ দিয়ে মনের কথা বলার ব্যবস্থার খোঁজ মিলেছে এ শহরে। তবে বন্ধুদের সঙ্গে নয়, রীতিমতো রেজিস্ট্রেশন করে এক দল প্রশিক্ষক এবং প্রশিক্ষণ নিতে চাওয়া মানুষদের সঙ্গে।
এ ভাবে আড্ডার ক্লাসে ভর্তি হওয়ার কথা শুনে অবাক হচ্ছেন বহু প্রবীণ বাঙালিই। তবে ব্যস্ত দিনে, কমতে থাকা যোগাযোগের যুগে আড্ডাপ্রিয় কলকাতাও হারাচ্ছে সেই জমজমাটি রকের মেজাজ।
পাড়ার রক, গলির মোড়ের চায়ের দোকান, কলোনির ক্লাবের যুক্তি-তক্কো-গপ্পকে ছাড়তে বসার নস্ট্যালজিয়া ছাপিয়ে এখন ঘিরে ধরেছে চিন্তা। একাকিত্বের!
মেট্রোপলিটন মেজাজে বুঁদ হতে বসা কলকাতাকে যখন শহুরে একাকিত্ব গ্রাস করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সাধারণ মানুষ থেকে বিশেষজ্ঞ সকলেই, তখনই তা কাটিয়ে ওঠার প্রয়াসও শুরু হচ্ছে এক এক কোণে এক এক ভাবে। কেউ তৈরি করেছেন আড্ডার উপযোগী কাফে তো কেউ তৈরি করেছেন অভিনব মেজাজের বৃদ্ধাশ্রম। তাতে কিছু সুবিধে হলেও, আসল ফাঁকটা যে থেকেই যাচ্ছে। মনের কথা বলবেন কার সঙ্গে? সেই মানুষটারই তো খোঁজ নেই।
শহরের কয়েক জন তরুণ এ বার সেই গপ্পের সঙ্গীদের সন্ধান দিচ্ছেন। এক জন-দু’জন নন, একসঙ্গে জনা পনেরোর আড্ডা বসছে টি বার-কফি শপ কিংবা বাড়ির দালানে। চেনা মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে না পারলেও অচেনাকে চিনে নিতে শেখাচ্ছেন তাঁরা। জীবনের ভাল স্মৃতি, মন্দ অভিজ্ঞতা— সবই ভাগ করে নেওয়া চা-কফির সেই আড্ডায় বসে।
সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে রেজিস্ট্রেশন করলেই হল। সময় মতো ডেকে নেওয়া হয় আড্ডাখানায়। আয়োজকদের তরফে শৌভিক বিশ্বাস জানান, মাসে এক বার করে সেশন বসে তাঁদের। পেশায় কর্পোরেট ট্রেনার এই তরুণের বক্তব্য, ‘‘অনেক দিন ধরেই কর্পোরেট কায়দায় রপ্ত হয়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সেই কাজ করতে গিয়েই খেয়াল করি, বহু মানুষেরই এখন গল্প করার অভ্যাস নেই। তার জেরে কাজের জায়গাতেও আড়ষ্ঠতা অনেক বেড়ে যায়। অনেকেই নতুন লোক দেখলে সহজ ভাবে কথা বলার উৎসাহ পান না।’’
বিষয়টি নিয়ে একটু তলিয়ে ভাবতে শুরু করেই তাঁদের মনে হয়, কথা বলার মানুষের অভাব বেড়েছে। তাই কমেছে কথা বলার অভ্যাস। তার পরেই শুরু হয় মাসিক আড্ডার এই ক্লাস। শৌভিক জানান, সেই আড্ডায় গিয়ে যেমন অনেক কষ্টের কথা অবলীলায় ভাগ করে নেন অংশগ্রহণকারীরা, তেমনই আবার অন্যের উৎসাহ দেখে বহু কাজে অনুপ্রেরণা পান বাকিরা।
কড়ি দিয়ে আড্ডা কেনার ক্লাসটি কেমন ভাবে দেখছে শহর?
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব যথেষ্টই আশাবাদী। তাঁর বক্তব্য, বন্ধুদের সঙ্গে ‘অকাজের’ কথা বলার রেওয়াজটা চলে গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এ রকম বহু তরুণকে দেখি যাঁরা ইন্টারভিউটা ভাল দিয়ে এলেও গ্রুপ ডিসকাশনে গিয়ে আটকে যান। নিজেরাই স্বীকার করেন যে, অত কথা বলার অভ্যাস নেই অচেনা লোকের সঙ্গে।’’ এমন অচেনাদের মাঝে আড্ডা অনেকটাই ‘থেরাপিউটিক’ হবে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাছেও প্রয়াসটি বেশ অভিনব। তবে তাঁর বক্তব্য, এমন ধরনের আড্ডা তো অনেকটা ‘ব্লাইন্ড ডেটের’ মতো। কী অপেক্ষা করছে, তা বলা যায় না। ভাল হতে পারে, মন্দও হতে পারে। ফলে সাহিত্যিকের মতে, ‘‘উদ্যোগটিতে অ্যাডভেঞ্চার থাকলেও প্রাণের স্পর্শ বোধহয় থাকবে না!’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নীলাঞ্জনা গুপ্তেরও একই চিন্তা। তাঁর প্রশ্ন, এক ফাঁদ থেকে মুক্তি খুঁজতে আরও এক ফাঁদে পা বাড়ানো হয়ে উঠবে না তো? তাঁর মতে, আড্ডাকে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই এই ভাবনাকেও স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। এখন তো যান্ত্রিক পদ্ধতির যাপন, কোথাও নিজের মতো করে মেলামেশার সুযোগ পায় না শিশুরা। তারা বড় হয়ে হঠাৎ মিশুকে হবে কী করে? তাঁর মন্তব্য, ‘‘কেউ কারও সঙ্গে আড্ডা মারবে, সে তো ভাবতেও ভাল লাগে। কিন্তু মেলামেশাটাও নিয়ম করে শিখতে হবে, সেটা ভাবতে কেমন যেন লাগে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy