হাওড়ার সালকিয়ায় মামাবাড়িতে আমার জন্ম। যখন আমার আড়াই বছর বয়স, কলকাতায় চলে আসি। কলকাতায় আমাদের ঠিকানা ছিল, ১১২ নম্বর কলেজ স্ট্রিট। রূপম সিনেমার পাশে ছিল আমাদের বাড়ি। আমাদের ফ্ল্যাটের ওপরের তলায় থাকতেন সন্ধ্যারানী। পড়তাম মির্জাপুর সিটি কলেজিয়েট স্কুলে। তার পর বঙ্গবাসী কলেজ।
আমার ছোটবেলাটা খুব হেসে খেলে, হইহই করে কেটে গেছে। আমার বাবা অনিল বাক্চী যে খুব বিখ্যাত মানুষ, সেটা তখনও বুঝতে পারতাম না। কারণ আর পাঁচ জনের বাবা তাঁদের সন্তানের সঙ্গে যেমন ভাবে মিশতেন, আমার বাবাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের বাড়িতে কে না আসতেন! বাবার কাছে গান শিখতে আসতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য-সহ আরও অনেকে। এঁরা অসম্ভব ভালবাসতেন আমাকে।
আমার গানের হাতেখড়ি মায়ের কাছে। সন্ধেবেলা মা হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন গান শেখাতে। তা ছাড়া মা খুব ভাল পিয়ানোও বাজাতে পারতেন। মা লরেটো’র ছাত্রী ছিলেন। ইংরেজি গান গাইতেন। মায়ের থেকেই মূলত পাশ্চাত্য সঙ্গীতটা শেখা। এছাড়া অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গানও শিখেছি। আর বাবার কাছে শিখেছি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রাগাশ্রয়ী গান। আমার গুরু ছিলেন, ওস্তাদ মেহেদি হুসেন খাঁ। তাঁর কাছে যখন গানের হাতেখড়ি, তখন আমার বয়স হবে ৬-৭ বছর। গুরুজির কাছে আমি দশ বছর গান শিখেছি। উঁনি আমার বাবারও গুরু ছিলেন।
আরও পড়ুন, অর্ধশতক পার, আবার যাত্রা স্মৃতির চড়াইয়ে
বেশ মনে পড়ছে, বাবার কার্ডে আমি ওস্তাদদের গান শুনতে যেতাম, কলেজ স্ট্রিট মিউজিক কনফারেন্সে। তখন বছর পনেরো বয়স হবে। সেখানে একবার ভীমসেন যোশী’র গান শুনে আমি মুগ্ধ। গানটা ছিল ‘জো ভজে হরি কো সদা’। তাঁর গাওয়া ভৈরবী রাগ আমার মন ছুঁয়ে গেল। গান শুনে বাড়িতে এসে আমি খুব কাঁদছি। বাবা দেখে বললেন, কী হল তোমার! আমি বাবাকে বললাম, আমার বোধহয় গান বাজনা আর হবে না। আসলে ভীমসেন যোশীর ওই রকম রেওয়াজ করা গলা, অসাধারণ কণ্ঠস্বর শুনে আমাকে হতাশা গ্রাস করেছিল। ভাবছিলাম এই উচ্চতায় তো কোনও দিনও পৌঁছতে পারব না। তবে গান-বাজনা করে লাভ কী! যদিও সেই গান শুনে এসে আমি বাবাকেও গেয়ে শুনিয়েছিলাম। বাবা খুব তারিফ করেছিলেন।
যখন গান-বাজনা শুরু করলাম, ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়ন হলাম, তার পর কলেজিয়েট চ্যাম্পিয়ন হলাম। মহীশূরে গান গাইতে গেলাম, ইন্টার ভার্সিটি কম্পিটিশনে। ওখানে আমি প্রথম হয়েছিলাম।
কলেজ শেষ হওয়ার পর বাবার সঙ্গে অনেক ছবিতে গানের সুর করেছি। আর বাবা অসম্ভব উৎসাহ দিতেন আমাকে। মনে পড়ছে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-তে মান্না দে’র সঙ্গে প্রথম যখন ভোলা ময়রার গান গাইলাম, তখন মান্না দে খুব অ্যাপ্রিসিয়েট করেছিলেন। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা! ‘কেউ বা করছেন ব্যারিস্টারি’ থেকে শুরু করে ভোলা ময়রার জায়গাগুলো আমি গেয়েছিলাম। আর ফিরিঙ্গির গলায় মান্না দে। সমস্ত কবির লড়াইটাই আমাদের কণ্ঠে। ভোলা ময়রার রেকর্ডিং-এর পর বাবা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ গানটার সুর কিন্তু আমারই করা। এই ছবির গানগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।
উত্তমকুমারের সঙ্গে লেখক।
উত্তমকুমারের সঙ্গে লেখক।
এর পর মান্না দা’ও খুব খুশি হয়ে আমায় একটা রেকর্ডিংয়ের কথা বললেন। মান্নাদা’র সুরে, পুলকবাবুর লেখা ‘চাঁদ বিনা সারা দিন বেশ তবু কেটে যায়। রাত তবু কাটতেই চায় না।’ এবং ‘যখনই গানের মুখ মনে আসে না, তোমার মুখটি মনে করি’ গানগুলো গাইলাম। এই প্রথম আমার নিজস্ব গান রেকর্ড হল, এইচএমভি থেকে। এর পর একে একে অনেক বাংলা ছবির গানে সুর দিয়েছি। ‘বনবাসর’, ‘দুই পুরুষ’। এই ‘দুই পুরুষ’ ছবিতে উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন। পরিচালনায় ছিলেন সুশীল মুখোপাধ্যায়। এই ছবির বিখ্যাত গান ‘বেহাগ যদি না হয় রাজি’ এই গানে সুর দিয়েছিলাম আমি। মান্না দে গেয়েছিলেন। এর পর মান্নাদা, সন্ধ্যাদি, শ্যামলদা এঁদের কে নিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম। পুলকদা, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত এঁরা বাড়িতে আসতেন বাবার কাছে। এঁদের লেখা অনেক গানেই আমি সুর দিয়েছি। এর পাশাপাশি বাবারও অনেক ছবিতে কাজ করেছি।
কাজের সূত্রে উত্তমদার সঙ্গে আমার পরিচয় পর্বটা ছিল বেশ মজাদার। আমি একবার টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে গানের রেকর্ডিং করছি। উত্তমদা আমার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি গানে সুর দাও?’ বললাম, হ্যাঁ। তখনও আমি ঠিক বুঝতাম না উত্তমকুমার মানুষটার জনপ্রিয়তা। এক সময় ‘বন পলাশীর পদাবলী’ ছবিতে পরিচালক উত্তমকুমার, আমি সঙ্গীত পরিচালক। উত্তমদা’র সঙ্গে কাজের অনুভূতিটাই ছিল অন্য রকম। আমাকে উঁনি খুব স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন, বন্ধুর মতো মিশতেন। এই সময় আমি সবে মাত্র কলেজ পাশ করেছি। উত্তমদা হাতে ধরে সব কিছু শেখাতেন। যেমন, কী ভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। আসলে আমি খুব ক্যাজুয়াল থাকতাম। ভাল কি মন্দ, সব বিষয়ে মুখের উপর সরাসরি বলে দিতাম। এর জন্য অবশ্য উত্তমদা আমাকে খুব পছন্দ করতেন। এই মানুষটাই এক সময় আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি মানুষটাকে। খুব পরোপকারী, সৎ একজন মানুষ। অনেক পরিচালককে নিজে বলেছেন আমার কথা। ‘ছেলেটা অসম্ভব ভাল কাজ করছে’। এ সব কী ভোলা যায়!
আমার কলেজ জীবনের কথা বলি। এই শহরেই আমার প্রেম। আমি বঙ্গবাসী কলেজে পড়তাম, আর প্রেম করতাম স্কটিশের একটি মেয়ের সঙ্গে। আমাদের আড্ডার জায়গা ছিল হেদুয়া, কফি হাউস এ সব। আমরা একসঙ্গে মহীশূরে ইন্টার ভার্সিটি কম্পিটিশনেও গিয়েছিলাম। আমি অভিনয় এবং গান, আর ও অভিনয়ের জন্য। ওই প্রেমিকাই আমার স্ত্রী হয়, রুবি বাক্চী। পরবর্তী কালে রেডিওয় চাকরি করত, আকাশবাণীতে। যাই হোক, আমাদের প্রেমের শুরু কিন্তু কফি হাউস থেকেই। মা আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন। আমি মাকে বলে দিয়েছিলাম আমাদের সম্পর্কের কথা। মা-কে বললাম, আমি একজনকে ভালবাসি। মা প্রথমে ঠিক অ্যাকসেপ্ট করতে পারেননি। একটু গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলেন, ওকে তুমি কেমন ভালবাসো? বন্ধুর মতো? মাকে ঠিক বোঝাতে পারতাম না। বলতাম ভালবাসি। তার পর আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্ক গভীরতা পেল। আমাদের আরেকটা আড্ডার জায়গা ছিল কলেজ স্কোয়ার। ওখানে পুলুদা (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়), ওর ছোট ভাই অভিজিৎ এবং কল্যাণ দে এ রকম আরও অনেকে আসতেন। আসলে ছোটবেলা থেকেই আড্ডায় বড়দের সঙ্গে আমার আদান-প্রদান ছিল।
কলেজে পড়াকালীনই ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ মুক্তি পেয়েছিল। আর ছবির গানগুলোও খুব হিট করেছিল। আমার তখন খুব নামডাক হল। ‘অধীর বাক্চী’ হিসেবে পরিচিতি পেলাম। কলেজে, নানান ফাংশনে গান করে বেড়াচ্ছি। তখন থেকেই শিল্পী হিসেবে সঙ্গীতজীবন শুরু। আসলে জীবনে যেটাই হতে পেরেছি সবটাই আমার গুরু ওস্তাদ মেহেদি হুসেন খাঁ-র প্রভাব। উঁনি বলতেন খুব সহজ সরল ভাবে গান গাইতে।
কলেজে পড়াকালীন আমি রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হই। পরবর্তী কালে সেই সূত্রেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয়। উঁনি আমার গানেরও ভক্ত হয়ে যান। এই কলেজ লাইফটাই ছিল আমার জীবনের সেরা সময়। ২০১৫ সালে মমতা বন্দোপাধ্যায় আমাকে ‘সঙ্গীত সম্মান’ প্রদান করেন।
এখন বয়সের ভারে মনটাও অন্য রকম হয়ে গেছে। সেই কলেজ জীবনটাকে খুব মিস করি এখন। আস্তে আস্তে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছি। টুকরো টুকরো অনেক কথাই মনে পড়ছে... যেমন বাবা কখনওই বুঝতে পারেননি যে, আমি সঙ্গীতজগতে নাম করব। তবে মা কিন্তু অনেক আগেই আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, তুমি একদিন মস্ত বড় শিল্পী হবে। আর বলতেন সব সময় মনটাকে শিল্পীর মতো রেখো। কোনও দিনও অহঙ্কার যেন না হয়। আর নেশা-ভাং কোরো না। তবেই বড় শিল্পী হতে পারবে। এখনও মায়ের এই কথাগুলো যেন স্পষ্ট কানে শুনতে পাই।
মান্না দে-র সঙ্গে লেখক।
মান্না দে-র সঙ্গে লেখক।
আমার জনপ্রিয়তায় বাবা খুব গর্ব বোধ করতেন। বাবার সঙ্গেও আমার সম্পর্কটা খুব সুন্দর ছিল। আমি যখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ পেলাম, বাবা খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমি যেটা করিনি, তুমি সেটা করো। তবে বাবা কিন্তু কখনওই নিজের প্রভাব খাটিয়ে আমাকে কিছু পাইয়ে দেননি। সে জন্যেই হয়তো লড়াই করতে শিখেছি।
একটা ঘটনার কথা বেশ মনে পড়ছে। আমি একদিন কলেজ থেকে আকাশবাণীতে গিয়েছি জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে। রেডিওর অডিশনের জন্য পাঁচ টাকা দিয়ে একটা অডিশন ফর্ম ফিলাপ করে। জ্ঞানপ্রকাশবাবু আমাকে হঠাৎ ডাকলেন। বললেন, ‘তুমি কী গান করো? তোমার নাম কী?’ বললাম, আমার নাম অধীর বাক্চী। বললেন, বাবার নাম কী? বললাম, অনিল বাক্চী। ওঁকে বলে দিয়েছিলাম, আমি অডিশনে গিয়েছি, এ কথা বাবাকে যেন না বলেন। শুনে অবাক হয়ে বললেন, ‘ওহ, অনিলদা’র ছেলে তুমি!’ তৎক্ষণাৎ টেনে আমাকে অডিশন রুমে নিয়ে গেলেন। আধুনিক, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি আর অতুলপ্রসাদের গান গাইলাম। পাশও করলাম। এর পর সে দিন বাবাকে তিনটের সময় ফোন করে জ্ঞানবাবু বললেন, অডিশনের কথা। বাবা অবাক হয়ে বললেন, আমার ছেলে! কিন্তু অধীর তো শুয়ে আছে। তখন বাবার আর বুঝতে কিছু বাকি রইল না। এর পর বাবাই আমাকে খবরটা দিলেন, আমি অডিশনে পাশ করেছি। বাবা তখন বললেন, এ ভাবে গান করলে কিন্তু চলবে না। তখন থেকে খুব সিরিয়াসলি আমাকে গান শেখাতে শুরু করলেন বাবা। এমনকী এর পর থেকে রেডিওতে বিভিন্ন পরীক্ষায় পাশ করে, নিয়মিত বেতারে গান গাইতে থাকলাম।
আমার জীবনের প্রাপ্তির ঝুলি একেবারে পূর্ণ। বড় বড় শিল্পীদের সঙ্গে গান করেছি, গান শিখিয়েছি। এ সব কিন্তু কলকাতাই আমাকে দিয়েছে। জয়া সিংহ নামে এক ছাত্রীকে আমি মনের মতো করে তৈরি করতে পেরেছি। হৈমন্তী শুক্ল আমার কাছে গান শিখেছেন, তখন বাণীচক্রে গান শেখাতাম। আমার ছাত্র ছিল মনোময় (ভট্টাচার্য), শুভঙ্কর ভাস্কর, শম্পা কুণ্ডু। ওরা আজ প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। খুব ভাল লাগে ওদের এ জায়গায় দেখতে পেয়ে। কত স্মৃতি... গান তোলাচ্ছি সন্ধ্যাদিকে। উঁনি বলছেন, ‘বাঃ, সুরটা কী ভাল লাগছে! কিন্তু ঠিক তোর মতো হচ্ছে না রে’। এই যে কথাগুলো, আজও বুকে বাজে।
এখনও আমি কাজের মধ্যেই থাকি। গানের সুর করি। এই তো জটিলেশ্বরদা (মুখোপাধ্যায়) দুটো গান দিয়েছেন আমাকে সুর করতে। গান শেখাতে ভালবাসি। ছেলে-মেয়েরা গান শিখতে আসে আমার কাছে। ওদের বলি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চাটা যেন সব সময় বজায় রাখে। এখনও রোজ সকালে কয়েক ঘণ্টা নিয়ম করে রেওয়াজ করি। আজও কিন্তু আমার মানুষের সঙ্গে মিশতে, কথা বলতে ভাল লাগে। এ ভাবে বাকি দিনগুলো কেটে গেলেই হল।
অনুলিখন: পিয়ালী দাস।
ছবি সৌজন্যে: লেখক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy